বৃহস্পতিবার, ১৬ জুলাই, ২০২০

এক মিলনগাথা !!

খেরকুটিয়া নদীর নীল জলে হাঁস চরে। দূরঘাট দিয়ে নৌকো যায়। নদীর অলস স্রোতে কচুরিপানার ভেসে আসা, ভেসে যাওয়া; আমি ভাবি, এই আমার দেশ, আবার দেশ নয়। আমাদের হুরে দিশাহীন জীবনে এই দৃশ্য যেন কোনো পুরোনো বইয়ের ছেঁড়া পাতা।

হেমন্তের মাঠে ধান কাটার মনোরম দৃশ্য। পড়ন্ত  রোদে মহিলারা ধান কাটায়  ব্যস্ত। পুরুষরা সেই ধান-কাঁধে বাড়ির পথে। এই ধান থেকে চালে পৌঁছনোর রাস্তা বড় সোজা নয়। প্রথমে ছড়া থেকে ধান আলাদা করা, তারপর অনেক পথ পাড়ি দিয়ে তবে সে চাল হয়। সে যাই হোক, আসল কথা হলো, এই যে ধান  কাটা আর মাঠ থেকে বাড়ির উঠোন, এই চলনের ছন্দটা আমাকে একটা যেন আনন্দের আবেশ দিয়ে ঘিরছে। আমার আজ বিকেলের এই অলস অবসর আমাকে যেন পূর্বজন্মের স্মৃতি মনে করাচ্ছে।

লুইট নদী লোহিতের আদরের নাম; কেমন শান্তটি  হয়ে শুয়ে আছে। ছোট ডিঙি নিয়ে দিনের শেষে নদী হাতড়ে বেড়ায় গাঁয়ের মানুষ। দূরে  জাল পাতা। এক মেছোবক জলের দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবছে। নদীর চড়ায় দুটো শামুক ভাঙা পাখি। দাঁড়িয়ে আছি বাঁশের সাঁকোয়, একটু ঝুঁকে মাঝিকে সুধোই, কি পাইলা, মাঝি? আমার ওই টুকু নড়াতেই সাঁকোয় খচরচর, নিজেকে সামলাই কোনোমতেমাঝি হাসে, বলে, ভিনদেশি  দেখি, বাসা কইহানে? কলকাতা, অয়,পাইসি কয়খান বরিয়ালা। উত্তরবাংলায় বরোলি শুনেছি, বরিয়ালা শুনিনি। জিজ্ঞাসা করব, তার আগেই ডিঙি এগিয়ে গেছে নদী বেয়ে। 

আজ যাবো, মাজুলি। একা মানুষ, পথে এপা ওপাশ তাকাই। নিমাতি, নিমাতি, নিমাতি  শুনে এগিয়ে যাই গাড়ির দিকে। যাইবেন নাকি? হ্যাঁ, কমলাবাড়ি ঘাট। অ, কমলাবাড়ি, কৈ যাইবেন, মাজুলি? হ্যাঁ, কেউ থাহে? নাএকা আইসেন? হ্যাঁবয়েন, বয়েন। ভিতরে ঢুকে বসি। গাড়ি চলে। বাজার ছাড়িয়ে পাড়া ছাড়িয়ে গাড়ি ধান ক্ষেতের মাঝ বরাবর পাকা রাস্তা দিয়ে ছুটে চলে। মাঠভরা পাকা ধান, হেমন্তের সোনালী রোদ সব মিলিয়ে যেন কেমন যেন নেশা লাগে। পৌঁছলাম কমলাবাড়ি নিমাতি ঘাটে। সামনে ব্রহ্মপুত্র, বিশাল ডানা মেলে শুয়ে আছে। দূরে তাকাই, যতদূর চোখ যায়, ধু ধু বালির চর। শুশুক লাফায়। টিং টিং টিং টিং, ওরে বাবা নৌকো ছাড়বে, তাড়াতাড়ি টিকিট কেটে নৌকোয় উঠি। গাড়ি, লরি সব নিয়ে সেই নৌকো চলেছে মাজুলি।

নৌকো ব্রহ্মপুত্রের বুক চিরে এগিয়ে চলেছে। নদীর বুকে পলি পড়ে চড়া। সূর্যের আলোয় চড়ার বালী চিক চিক করে। হঠাৎ কেন জানি বাবার কথা মনে পড়ে। দেশভাগের আগেই কর্মসূত্রে এপারে চলে আসা। কলকাতা শহর। আদি বাড়ি ছিল বরিশালে। সেখানে চেনা সুখ চেনা দুঃখের আটপৌরে জীবন। বাংলা দেশের কথা তারা কোনোদিনই ভুলতে পারেন নি। ছোট বেলা থেকেই আমরা সেই বরিশাল, মেঘনা, ব্রহ্মপুত্র শুনেই বড়ো হয়েছি। বাবা আজ আর নেই, কিন্তু আজও ওই বাড়ি সেই পূর্ব বাংলার গল্প বলে। আমরা কোনো দিনই বাংলা দেশে যাই নি, শুধু শুনে শুনেই এক ঘুঘু ডাকা ছায়ায় ঢাকা ছোট্ট গ্রামের ছবি মনে আঁকা হয়ে গিয়েছিল। আর ছিল এক নদী, তার নাম কীর্তনখোলা। এমন সুরেলা নামের নদীর নাম আর কখনও শুনিনি। সেই নামখানি মনের ভিতরে যেন একখানি নকশিকাঁথা হয়ে বিছিয়ে আছে। বাবার কাছে শোনা, শীতের দুপুরে কীর্তনখোলার জল জোয়ারের টানে প্রায় উঠোনে উঠে আসত। সেই সুপুরি নারকেল গাছে ঘেরে গ্রাম্য জীবন নদী আকাশ মানুষের সাথে এক অদ্ভুত বন্ধনে আবদ্ধ ছিল। জেগে আছ, নাকি ঘুমোলে? কে ডাকে? চারপাশে তাকাই, না,কেউ তো নেই। ভাবনার সুর কেটে যায়। নদীর কোলে উঁকি দিই, চিনতে পারো আমায়? নদীর হাওয়ায় ব্রহ্মপুত্রের ইশারা। ডাকলে আমায়? কত কাল পরে দেখা। আমি আশ্চর্য হই, কি করে চিনলে আমায়? নদীতে কুলুকুলু, বলে, চিনি নি, শুনেছি। কীর্তন আমায় ডাক দিল যে। অবাক হয়ে বলি,তু মি ওকে চেনো? .........সে যেন শুনতেই পেলো না, কীর্তন তোমার শরীরের শিরা উপশিরায় বয়ে চলেছে, মনে, চেতনা অবচেতনে সে তোমার সাথে জড়িয়ে আছে, বলে চলে সে। আমার চোখ জলে ভরে ওঠে, অজান্তেই। কিন্তু, তাকে তো আমি কোনো দিন দেখিই নি,এইতো, এইতো আমিবলতে বলতে চোখ দিয়ে সে অঝোর ধারায় বেরিয়ে আসে, আমার ভিতরে মোচড়ের পর মোচড়, বুকের ভিতরের নকশিকাঁথাটান পড়ে কীর্তনকে বুকে পেয়ে হেমন্তের ব্রহ্মপুত্র খুশিতে কলকলিয়ে ওঠে, এইবার আমরা বেশ সবাই সবাই হলাম। নৌকো আপন মনে উজিয়ে চলে ব্রহ্মপুত্র বেয়ে...........মাজুলির দিকে। 

২টি মন্তব্য:

কবিতা ৮ ।

 সপ্তসিন্ধু পার করে লখিন্দর ফেরে ঘরে।সাথে করে  বিবিধ রতন। শঙ্খ বাজে, উলু দেয় এয়োতি, পুরজন। বাপ তার, চন্দ্র সওদাগর। লখার সাফল্যে মুখে তার  গো...