সোমবার, ১৩ জুলাই, ২০২০

সেই দরজাটা !!

হাঁটছি পাহাড়ে। উপরে উঠছি ধীরে ধীরে। উচ্চতার সাথে সবুজ কমে আসছে। প্রায় তিনটে বাজে। বেলা ক্ষয়ে আসছে। আরও অনেক পথ এখনো বাকি। আলো থাকতে থাকতে পৌঁছতেই হবে। এক অশেষ ক্লান্তি ধীরে ধীরে সারা শরীরকে যেন আচ্ছন্ন করে ফেলছে। তবুও থামা যাবে না। এক অমোঘ অনিবার্য কারণে এগিয়ে চলি। পাহাড়ে চড়ার একটা নিয়ম আছে। সামনের দিকে ঝুঁকে চড়াই পথ চড়তে হয়। আমিও সেই নিয়মের ব্যতিক্রম নয়। হঠাৎ থামতে হয়, পথ থেকে চোখ তুলে দেখি সামনে আর পথ নেই। দাঁড়িয়ে আছি এক বিরাট বন্ধ দরজার সামনে। আর এগোতে গেলে সেই দরজা পার করতে হবে। কেউ কোথাও নেই। দাঁড়িয়েই আছি। ওপর থেকে নাকি ওপার থেকে নাকি হাওয়ায় এক স্বর ভেসে এলো, অপেক্ষা করো।

ঘুমটা ভেঙে গেল। এদিকে গলা শুকিয়ে কাঠ। জল খেয়ে স্থির হয়ে বিছানায় বসলাম। মাথার মধ্যে সেই  বন্ধ দরজা..................

তারপর কত কত দিন কেটে গেছে। কিন্তু মাথার ভিতরে দরজাটা বন্ধই রয়ে গেছে। কতবার হিমালয়ে গেছি। নদীর ধারে ধারে, পাহাড়ের সবুজ চারণভূমিতে, যেখানে ঝর্ণার ধারামুখ দিয়ে বরফগলা জলের ধারা বেরিয়ে আসছে, খাড়া পাহাড়ের গায়ে ছোট-বড় কত গুহামুখ, যেখানে পাহাড়ি পশুপালকরা ছাগল ভেড়া নিয়ে রাতে আশ্রয় নেয়; কিন্তু না, কোথাও কোনো দরজা দেখিনি আমি

তারপর সময়ের সাথে সাথে সেই বন্ধ দরজার স্মৃতির ওপর ধুলো জমে। সময়ের নিয়মে স্মৃতিও ঝাপসা হয়ে আসে

‌দিন তো থেমে থাকে না। সারা পৃথিবী জুড়ে ঘটনার ঘনঘটা। আজ যা ঘটেছে, আগামী কাল তাই অতীত হয়ে যাচ্ছে। এত বেশি ঘটনা ঘটছে যে ঘটনার পরম্পরা  বলে কিছু থাকছে না। দৈনন্দিন জীবনের গতিও এত বেড়ে গেছে, সমাজেরও দিশাহারা অবস্থা। সব ঘটনা প্রত্যক্ষও হয়তো নয়, তবুও প্রাত্যহিক খবরের কাগজের কালোকালির শব্দগুচ্ছ মনের উপর কিছু আঁকিবুঁকিতো কাটে

‌কাগজ খুললেই  আমাজনের জঙ্গলের আগুন, কোথাও বিধ্বংসী ঝড়, কখনও হিন্দুকুশে পঙ্গপালের আক্রমণ। পৃথিবী জুড়ে প্রকৃতির মহাতাণ্ডব। এরমধ্যে মানুষও কম যাচ্ছে না। কখনও ভেনিজুয়েলার গৃহযুদ্ধ তো কখনও চিনদেশে উইঘুরদের ওপর রাস্ট্রচাপ

‌মোটের ওপর সহজ কথা হলো মৃত্যু কালে প্রবেশ করেছি আমরা। আমাদের চারপাশে মৃত্যু হানা দিয়ে ফিরছে, সে যেরূপেই হোক। মানুষে, প্রকৃতিতে মিলে এক মহাখেলায় অংশ নিয়েছে। যুযুধান দুই প্রতিপক্ষ একে অপরকে ধ্বংসের এক ভয়ংকর প্রতিজ্ঞা করেছে। ঈশ্বর দেখছেন; দুজনকেই তিনি পরম যত্নে সৃষ্টি করেছেন, প্রকৃতি-সত্বা এবং মানবসত্ত্বা দুয়ের  মধ্যেই তো তিনি, তবে কেন এই বিপর্যয়?

‌ওই দেখো, মৃত্যু কেমন তাড়া করে ফিরছে, পালাচ্ছে মানুষ। কোথাও কাঁটাতার পেরিয়ে, কোথাও ডিঙি চড়ে অকুল সমুদ্র পাড়ি....জীবনের মায়া বড়োই রহস্যময়। দৌড়ও আরো জোরে, পিছনে মৃত্যু। তার কোনো তাড়া নেই

‌এদিকে তাকাও, হাজার হাজার পা হেঁটে চলেছে রাজপথ দিয়ে, রেলপথ ধরে। বাড়ি যেতে চায় তারা। এরা কারা? কবি বলছেন, এরা দেবতা, এরা মানুষ, এরা কুলিমজুর, কল-কারখানার শ্রমিক। এরা সভ্যতার বাহক, এরা ছাড়া সভ্যতা অচল। অথচ আজ এদের পরিচয় শ্রমিক নয়, এক আজব শব্দের খাঁচায় এরা বন্দি, পরিযায়ী। সভ্যতা কত নৃশংস হলে এই শব্দ সমাজে মান্যতা পায়? নিজের দেশের মধ্যেই কি ভাবে তারা পরিযায়ী হয়ে গেল, তবে কি এই দেশ তাদের দেশ নয়? তাদের মনের এই যন্ত্রণা কিসের উত্থানের ঈঙ্গিত বয়ে আনছে? ওরা আর আমরা, সেই স্বপ্নে দেখা দরজাটার এপার, ওপার

‌সেই ছোট্ট মেয়েটা, ছোট্টো ছোট্টো দুটো পায়ে শত শত মাইল হেঁটেছিলো, শুধু বাড়ি ফিরবে বলে। গ্রামে পৌঁছনোর মাত্র চোদ্দ কিলোমিটার আগে পথেই মরে গেল। আসলে মৃত্যু ও তার কষ্ট দেখে থাকতে পারেনি, ছুটে এসে তাই কোলে তুলে নিয়েছিল। সেই শিশুটি নাবালিকা ছিল, শ্রমিকও ছিল। পুরোটা লিখলে দাঁড়ায় যে, নাবালিকা শিশুটি পরিযায়ী শ্রমিক ছিল। ভারতে এমন কত শিশু শ্রমিক আছে, কেউ তো জানেই না। মেয়েটি ভাগ্যিস মরে গেল, তাই তো এই আশ্চর্য কথাটা জানা গেল

‌ঈশ্বর হাসছেন। ঈশ্বর হাসছেন। মানবজাতির প্রতি স্নেহে, তার শিশুসুলভ আচরণ দেখে তিনি কৌতুক বোধ করছেন। পৃথিবীতে মানবজাতিই তো পরিযায়ী। কোথা থেকে এসেছে কেউ জানে না, কোথায় যাবে তাও জানা নেই। পৃথিবীতে এসে নিজের নিজের কর্ম করছে, তারপর কর্ম শেষে ঠিক ওই শ্রমিকদের মতো নগন্য হয়ে সব ফেলে রেখে চলে যেতে হবে। প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলেই এই পৃথিবী সব সম্পর্ক অস্বীকার করবে, ছুঁড়ে ফেলে দেবে কালের করাল মুখে, ফিরেও দেখবে না

‌আজ আমার সামনে সেই বিরাট দরজাটা  আবার দেখতে পাচ্ছি যেন। এবার চাবিটা বোধহয় পেয়েই যাবো, অথবা দরজাটা নিশ্চিত খুলেই যাবে

1 টি মন্তব্য:

কবিতা ৮ ।

 সপ্তসিন্ধু পার করে লখিন্দর ফেরে ঘরে।সাথে করে  বিবিধ রতন। শঙ্খ বাজে, উলু দেয় এয়োতি, পুরজন। বাপ তার, চন্দ্র সওদাগর। লখার সাফল্যে মুখে তার  গো...