বিজ্ঞান বলে, এই পৃথিবীতে সবই নাকি আছে, শুধু খুঁজে নিতে
হবে। বেশ কথা। কিন্তু কি খুঁজবো? কবি বলেছেন, খ্যাপা পরশ পাথর খোঁজে, অর্ধেক জীবন ব্যয় হয়ে যায় তার, কোনো এক সময় পেয়েও
শুধুমাত্র না চিনতে পারার জন্য আবার হারিয়ে যায়। জীবন সায়াহ্নে এসে সে উপলব্ধি করে
যে আবার তাকে পুরোনো পথেই ফিরে যেতে হবে, কারণ ওই পথেই সে
অসাবধানে সেই অমূল্য রতনটি ফেলে এসেছে। ঠিক এই খানেই সেই অমোঘ প্রশ্নটি মনে জাগে, সময় পাওয়া যাবে কি? কে জানে.......
আসলে আমরা সবাই সর্বক্ষণই কিছু না কিছু খুঁজে চলেছি। তাই না? আমিও তার ব্যতিক্রম নই। আমিও খুঁজে চলেছি। শহুরে জীবনের বিস্তর খোঁজাখুঁজির
মাঝে জীবনটাই হারিয়ে গেছে। এখন বেঁচে আছির বদলে টিকে আছি বললেই বোধহয় সত্যটুকু
সুবিচার পায়।
বেশিদিন বাড়িতে থাকতে পারি না। দমবন্ধ লাগে। সময় সুযোগ বুঝে হরিদ্বার যাওয়ার
টিকিট কাটি।.....ভোরেরবেলায় ট্রেন থেকে নেমে হোটেলে যাই। তারপর স্নান সেরে সোজা হর
কি পৌড়ি ঘাটে।...দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখি কত মানুষ, ভোর থেকেই
পুণ্যার্থী, সাধু, ভবঘুরে সবাই একঠাই। কেউ শীতল হয়, কেউ পুন্য মাপে। আর
কত যে ভিখিরি, কেউ গেরুয়া বসনে, কেউ ছিন্নবস্ত্রে। এই ভারতবর্ষে যুগে যুগে গঙ্গার ধার বরাবর এই ভিক্ষাকর্মীদের
এক চলমান জীবনযাত্রা। সে বিশ্বনাথের কাশীই হোক অথবা এই হরিহরের দুয়ার, এর কোনো পরিবর্তন নেই। রোদ বাড়ে, আমি ফেরার পথে ধরি। সন্ধ্যার আগে আবার আসি। একটু পরেই আরতি শুরু হবে। ধীরে ধীরে আরতি
দর্শনার্থীদের ভিড় বাড়ে। আরতি শেষে যে যার ঘরে ফিরে যায়। শেষ সন্ধ্যায় ঘাটেরও
ক্লান্তি আসে। পাহাড়ের হাওয়ায়, গঙ্গার কুলু কুলু
ঘুমপাড়ানি গানে ঘাটও একসময় ঘুমিয়ে পড়ে। বসে আছি ঘাটের কিনারায়, নদীর জল ছুঁয়ে, এই সময় অনেক পুরোনো কথা মনে আসে। জলে ফাঁড়া ছিল বলে ছোট বেলায় জলের কাছে যাওয়া
বারণ ছিল। আজ নদীর জল ছুঁয়ে বসে আছি। কেউ আর নিষেধ করার নেই, সবাই আজ আকাশের তারা হয়ে গেছে। হয়তো সেখান থেকেও বারণ করছে, কে জানে। আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি। চাঁদের হালকা আলো নদীর শরীরে ছায়া জড়ায়, সেই অন্ধকারে, নদী পাশ ফিরে শোয়। ওপারের দোকানগুলোর
আলো সব নিভতে শুরু করেছে, এবার ফিরতে হবে। নদীকে বলি, কাল আবার আসবো, কেমন? এই আমার এক রোগ, সবার সাথেই কথা বলি। পিছন থেকে কে যেন টেনে ধরে, একবার আমার উজানে
যাবে? আমার ছোট বেলার খেলাঘর। পিছন ফিরি, কই কেউ না তো, শুধুই কুলু কুলু কুলু কুলু.........। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে
যায়, উঠে পড়ি। প্রথম বাসটাই ধরবো ।.....
বাসে উঠে একটা জানলার ধারে জায়গা পেলাম। বাস চলতে শুরু করতেই না ডাকতেই ঢুলুনি
এলো, জলদি উতরো, ঘুম ভেঙে যায়, ব্যাসী পৌঁছেছি। আলুর পরোটা আচার দিয়ে খেয়ে আবার নিজের জানলার ধারে। জানলা
দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি। স্কুলের পোশাক পরা ছোট ছেলেরা স্কুলে যাচ্ছে, কোথাও বা রাস্তা তৈরি হচ্ছে। কোথাও পাহাড় থেকে নেমে আসা ধারায় দৈনন্দিন কাজ সারছে গ্রাম
র মানুষ। হিমালয়ে সাধুবাবারা হেঁটেই চার ধাম দর্শন করেন, তাঁরাও হেঁটে চলেছেন, হাতে কমন্ডলু, পিঠে এক ঝোলা। মাঝে মাঝে বাস দাঁড়াচ্ছে, দুচার জন নামছে, কেউ বা উঠছে। এই হলো হিমালয়ের পথে যাত্রার চলমান ছবি।
এসে গেলাম দেবপ্রয়াগ। ভাগীরথী আর অলকানন্দার বিবাহ স্থল। ওপর থেকেই দুজনার
হাতে হাত রেখে চিরজীবন সাথে চলার অঙ্গীকারের চিরপরিচিত ছবিটি বেশ দেখতে পাওয়া
যাচ্ছে। হঠাৎ মনে পড়ে হরিদ্বারের ঘাটে র কথা। গঙ্গা তো এক ধারা নয়, তিন ধারা মিলিত হয়েছে। এখন কি করি, অবশেষে ঠিক করলাম
অলকানন্দার উজানেই যাবো। রুদ্রপ্রয়াগে আজকের যাত্রাপথের বিরতি।
আজ জসীমঠ যাবো। গাড়োয়ালের সব শহর গুলোতেই অতিরিক্ত জনসংখ্যা বৃদ্ধির কুফল ফলতে
শুরু করেছে। এ পথের দূরত্বও অনেক। সারাদিন ধরে চলে নন্দপ্রয়াগ, কর্ণপ্রয়াগ সব পার করে চলেছি। চায়ের বিরতি। গাড়ি থেকে নাম হলো। উল্টো দিকে তাকিয়ে
দেখি এক বড় পাহাড়ি নালা, তাকে নালা না বলে নদী বলাই ভালো, ডানদিকের এক
উপত্যকা থেকে নেমে এসেছে। কি নাম ভাই, তোমার? তার উচ্ছলতা অবাক করে আমায়। আমার নাম বিরহী গো, বিরহী। আমি একটু
ঠাট্টা করে বলি, কিসের বিরহ তোমার, আর বিরহে বুঝি কেউ নাচে? সে নুড়ির নুপুর
বাজিয়ে এক পাক নেচে নিলো। এক দমকা হাওয়ায় গাছ থেকে কত পাতা যেন ঝরে পড়লো। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, কোন দেশ থেকে এসেছ তুমি? বিরহই তো নাচের
উৎস। না হলে শুধু শুধু কেউ নাচে? আমাদের দেবাদিদেব
মহাদেব, তাঁর স্ত্রী সতীর বিরহে কত কেঁদেছেন, তারপর সেই প্রিয়দেহ
বুকে নিয়ে যে ছন্দে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করেছিলেন, সেটাই তো নাচ। সেই
নাচের তালে পৃথিবী কেঁপে উঠেছিল, দেবতারাও জেগে
উঠেছিলেন। আহা, কতদিন আর অমন নাচ দেখিনা, বলতে বলতে সে উদাস
হয়ে গেল। কতক্ষন সে চুপ করে রইলো, তারপর যেন আপনমনে
বলতে লাগলো, তাঁর তো সেই শোকের আর বিরাম হলো না। তিনি তো এখনো কেঁদেই চলেছেন। সে অশ্রু
ধারাই তো আমার উৎস। তাই তো আমার নাম বিরহী। সেই দুঃখ ধারা আমি যুগে যুগে বয়ে নিয়ে
যায় সাগরে, তা নাহলে এই হিমালয় পর্বত কবেই তলিয়ে যেত। আমি হাঁ করে শুনছি, হঠাৎ সম্বিৎ ফেরে তার, বলে, দেখলে তো কত দেরি করিয়ে দিলে আমায়। সরো দেখি, পথ ছাড়ো, বলতে বলতেই ছুট দিলো। সেই বিরহের ছন্দ আমার প্রাণের গভীরেও কি এক ব্যথার
মূর্ছনা জাগায়। আবার গাড়ি চলে। অবশেষে জসীমঠ পৌঁছলাম। প্রায় চারটে বাজে। আজ এখানেই
থাকবো। কাল প্রথম গেট ধরে বদ্রিনাথ যাবো। রাতের আলো ঝলমলে জসীমঠ ভারী সুন্দর। অনেক
নীচে অলকানন্দার স্রোতকে ব্যবহার করে বিদ্যুৎ তৈরি হচ্ছে। সেই কর্মকান্ডের আলোয়
সারা পাহাড় আলোকিত। চাপা এক কান্নার আওয়াজ, কে যেন গুমরে গুমরে
কাঁদছে?
ভোরে উঠে মন্দিরে প্রনাম করে বদ্রীনাথ মার্গে দাঁড়িয়ে আছি। আজকের গন্তব্য
বদ্রীনাথ হয়ে মানাগ্রাম । এই গ্রামটি এই পথের শেষ জনপদ। এর পর আর কোনো জনবসতি নেই।
এই জসীমঠ থেকে বদ্রীনাথ পঞ্চাশ কিলোমিটার রাস্তা। দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম। কি ভিড়, ভক্তদের। ভক্তছাড়া ভগবান অচল। একটু এগিয়ে ঝোলাপুল পার করলেই স্বয়ং
বদ্রীবিশালের দরবার। নীচ দিয়ে বয়ে যায় অলকানন্দার ধারা। এককাপ চা খেয়ে মানাগ্রামের
গাড়ি ধরি। গ্রামে পৌঁছে স্থানীয় পঞ্চায়েতের সাথে কথা বলে তাঁবু লাগাই। সব ব্যবস্থা
করে পায়ে পায়ে ভীম পুল পার করে এগোই। এই পথ সোজা চলে গেছে বসুধারা প্রপাতের পায়ের কাছে। সরস্বতী মন্দিরের পাশ
থেকে সগর্জনে বেরিয়ে আসছেন মা সরস্বতী। প্রবল শব্দে কান পাতা দায়। কোথায় সেই শ্রীপঞ্চমীর শান্তশিষ্ট রূপের ঠাকরুনটি, একী ভয়ঙ্কর রূপ তার, বুকের ভিতর কেঁপে ওঠে। এত শব্দে পাশের লোকের কথাই শোনা যায় না, তো আমার বিড়বিড় করে চাওয়া তিনি শুনবেন কি করে? মরিয়া হয়ে প্রানপনে
চিৎকার করে বলি, বিদ্যা দাও। কি যে আশীর্বাদবানী উচ্চারিত হলো বলতে পারি না। বাঁদিকে অনেক নীচে
গিয়ে সেই ধারা অলকানন্দায় মিশে যাচ্ছে। সেই মিলনস্থল কেশবপ্রয়াগ নামে পরিচিত।
দেখতে দেখতে উপত্যকায় সন্ধ্যা নামে। আর কিছুক্ষণের
মধ্যেই প্রকৃতির আঙিনা তারার আলোয় আলোকিত হয়ে উঠবে। বদ্রীনাথের শয়ন আরতিও হয়তো শুরু
হয়েছে। কেশবপ্রয়াগের পুলের অপর পারে হালকা এক পথের নিশানা, আগামীকাল ওই পথ ধরেই আমি যাব। ওই অস্থায়ী কাঠের পুলটিই এপারের সাথে ওপারের
একমাত্র যোগাযোগকারী সূত্র। ফী বর্ষায় অলকানন্দা ওকে ভাসিয়ে নেয়, ওর চোখেও তখন অলকানন্দার মতই সাগর মিলনের স্বপ্ন, কিন্তু কোনোদিনই সে সাগরে পৌঁছয় না। নদীর কোন বাঁকে যেন আটকে পড়ে। পাহাড় বড়ো
মায়ায় তাকে পিছনে টেনে রাখে। নিকষ অন্ধকার নেমে আসছে, পাহাড়ের উপত্যকায়। সেই অন্ধকারে কে কাঁদে, খুব চাপা অথচ খুব
স্পষ্ট, সে গুমরানো কান্না। সেই কান্না যেন পাহাড়ের অন্দরে ঘুরে ঘুরে মুক্তির পথ খুঁজে
বেড়ায়। সরস্বতীর উদ্দাম গর্জনের সাথে মিশে সে গুমরানো কান্নার আওয়াজ সেই অন্ধকার রাতে
কি এক আসন্ন মহাবিপদের সূচনা চিহ্নিত করে চলেছে।
সকাল হয়। চারপাশে ছোট পাখির কলতান। উঁচু উঁচু সাদা মাথার বৃদ্ধ পাহাড়ের সারি, হাসিমুখে স্বাগত জানায়, কুশল জিজ্ঞাসা করে। তাঁদের প্রনাম জানাই। সূর্যের আলো তাঁদের আশীর্বাদ বয়ে আনে, সেই স্পর্শ আমায় পুন্যাঙ্গ করে, শিহরণ জাগায়। আসলে
হিমালয় দেবভূমি। সমগ্র হিমালয় অঞ্চলই সেই প্রাচীন কাল থেকে আজ পর্যন্ত পুণ্যব্রত মহান ঋষিদের তপস্যা
ভূমি। সেই তপস্যার পূতফল সেখানকার আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে আছে। আমায় যেতে হবে সত্যের
পথ ধরে সেই পুন্য সলিলার আঁতুড় ঘরে, যেখানে যেতে গেলে
শরীরের সাথে সাথে মনের শুদ্ধতার আবশ্যিকতাও বাধ্যতামূলক। সব গোছগাছ করে বেরিয়ে পড়লাম। অনেকটা পথ আজ
হাঁটতে হবে তাই আমার পথ প্রদর্শক সংগ্রাম সিংকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। সোজা উৎরাই
পথে কালকের দেখা কাঠের পুলটার কাছে নেমে আসি। তারপর সেই পুলটা পার করে ডানদিকের চড়াই পথ ধরে এগোতে থাকি। খানিক এগিয়ে
পশ্চিমমুখী পথের বাঁপাশে এক ছোট্ট মন্দির। মূল পথ ছেড়ে পায়ে পায়ে উঠে আসি মন্দিরের
চাতালে। চারপাশ তাকিয়ে দেখি, জনবসতির কোনো
চিহ্নই চোখে পড়ে না। মন্দিরটিও তালা বন্ধ। একটু হতাশ হই। পাহাড়ে সূর্যের তেজ খুব
চড়া । জল খেয়ে সংগ্রাম কে জিজ্ঞাসা করি। সংগ্রাম বলতে থাকে। সেই কবেকার কথা। নর ও
নারায়ণ নামের দুই ঋষি এই বদরিকা আশ্রমে এসে নারায়ণের তপস্যা শুরু করেন। সেই দুই ঋষির
অভাগিনী মা শুধু সন্তানদের চোখে দেখতে পাওয়ার আশায় সেই স্থানে এসে ঘর বাঁধেন। আমি
যেন সেই যুগে পৌঁছে গেছি। সেই পাণ্ডববর্জিত পাথরের সমুদ্রে এক মা শুধুমাত্র
পুত্রমুখ দর্শনের ইচ্ছায় সেই ভীষণ স্থানে যুগ যুগ ধরে অপেক্ষা করছেন। কথিত আছে, বছরে এক বিশেষ দিনে তিনি দুই পুত্রের দর্শন পান। প্রত্যেক বছর শ্রাবনমাসের
দ্বাদশী তিথিতে (যা বামন দ্বাদশী নামে পরিচিত) বদ্রীনাথ থেকে তাঁর দুই পুত্র ডোলিতে
চেপে মাতৃদর্শনে আসেন। সেই দিনটি সেই মায়ের জন্য সবচেয়ে আনন্দের দিন।সেই উপলক্ষ্যে
ঐ দিন মন্দির চত্ত্বরে বিরাট মেলা বসে। তারপর ঋষিদ্বয় আবার বদ্রীনাথে ফিরে যান। আর
সেই স্নেহপরায়না মাতৃহৃদয় একাকী সেই ভীষণ বিপদসংকুল প্রদেশে আবার এক বছরের জন্যে
সন্তানদের প্রিয়মুখ দর্শনের আশায় অপেক্ষায় বসে থাকেন। সেই জন্য মন্দিরটি মাতৃ
মূর্তি মন্দির নামে পরিচিত। শুনতে শুনতে আমার চোখের জল আর বাধা মানলো না । এক
আশ্চর্য উপলব্ধি হলো। ঈশ্বর কি এমন বস্তু যার জন্য মাকে এত কষ্ট দেওয়া যায় আর
সন্তান কি এমন বস্তু যে যার জন্য পৃথিবীর সব কিছু ত্যাগ করা যায়? এই নিষ্ঠুরতার অনুষ্ঠানের একমাত্র সাক্ষী সেই ঈশ্বর, যার উপাসনায় পুত্রেরা মাকে এত যন্ত্রনা দিচ্ছে। এই কথাগুলো যত তাড়াতাড়ি ভুলে
যাওয়া যায়, ততই ভালো। নিদারুন মানসিক যন্ত্রনায় এই ব্যথাতুর মানব হৃদয়, সেই ঈশ্বর আর তাঁর
উপাসকদের প্রানভরে অভিশাপ দিলো। তারপর নিজের চোখের জলে মায়ের মনের ব্যথার উপশমের
চেষ্টায় মন দিলো। সন্তানের নির্মমতায় মা যে পাথর হয়ে গেছেন। সন্তান আর সন্তাপের
মানে কি এক? দিদি, দিদি উঠো, মত রোও ইতনা, চলো, বহত দূর যানা হ্যায়। সংগ্রামের ডাকে যেন স্বপ্ন ভেঙ্গে যায়। কী এক অসহ্য
যন্ত্রনা থেকে পলকে মুক্তি পেয়ে বাস্তবে ফিরি। মাতৃমন্দিরে সাষ্টাঙ্গে প্রনাম করে পথে নামি। দূর থেকে ডানদিকে বসুধারার
স্বর্গীয় ধারা দেখা যাচ্ছে। ঐ ধারাজল সারা ভারতের তপস্যাব্রতীদের বড় সাধনার ধন।
কথিত আছে যে, পাপী শরীরে ওই জল স্পর্শও করে না। সামনে এক ভাঙাচোরা হিমবাহের ফুটিফাটা পাথুরে
অঞ্চল। ঝুরঝুরে পাথর আর বালি মাটির এক বিপদজনক সংমিশ্রণ। ওর ওপর দিয়েই আমাদের
রাস্তা। সাবধানে, ধীরে ওই চড়াইটা পার করে ওপরে উঠে আসি। ডানদিকের খাতে হিমবাহের হাঁ মুখ দিয়ে
অলকানন্দা বেগে বেরিয়ে আসছে। এরপর খালি চড়াই আর চড়াই। সাবধানে বোল্ডারের ওপর দিয়ে
দিয়ে এগিয়ে চলেছি। পথের অপরূপ সৌন্দর্য, বর্ণনার অতীত। ফুলে
ফুলে উপত্যকা ভরে আছে। আর হবে নাই বা কেন, এ পথ যে স্বর্গের
পথ, সত্যের পথ। এই পথ দিয়েই তো যুধিষ্ঠির সপরিবারে মহাপ্রস্থান করেছিলেন। সমগ্র
মহাভারতের মধ্যে এ এক অপূর্ব অধ্যায়। কী উন্নত দার্শনিক চিন্তার সমন্বয়, তুমি যেই হও, সময় ফুরোলে নিঃস্ব হয়ে একাকী এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হবে। পিছন ফিরে দেখা চলবে না। এই
দার্শনিক চিন্তার এই রকম অপূর্ব, তুলনাহীন প্রয়োগ আর
সারা পৃথিবীতে কোথাও নেই। এই একটি মাত্র পথ, যা স্বর্গারোহনের
পথ হিসাবে চিহ্নিত। এই পথ ঈশ্বর উৎসর্গ করেছেন মানব জাতির উদ্দেশ্যে, যে মানুষ নিজেকে ওই স্তরে উন্নীত করতে পারবে, ওই পথে তাঁরই
অধিকার। ভাবতে গিয়ে সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। আবারও এগিয়ে যাই। খানিক এগিয়ে একটা
সমতল মতো জায়গা। আজ এখানেই রাত্রিবাস। এই জায়গাটির নাম লক্ষ্মীবন। সবাই মিলে হাতে
হাতে তাঁবুগুলো লাগিয়ে ফেলি। তারপর গিয়ে কাছের এক উঁচু পাথরের ওপর বসে পড়ি। আঃ ! আজকের মত পা-দুটোর
বিশ্ৰাম। চারপাশে তাকিয়ে দেখি, এযে একেবারে
স্বর্গের চার রাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছি। ডানদিক থেকে সামনে বসুধারা জলপ্রপাতের
ধারা অবিশ্রাম ঝরে পড়ছে। না, পড়ছে না, এলোমেলো হাওয়ায় আঁচলের মতো উড়ছে। সোজা তাকালে অরোয়া অঞ্চল, অরোয়া নালা শতধারায় বিভক্ত হয়ে অলোকানন্দায় মিশে যাচ্ছে। বাঁ দিকে কোনাকুনি
উত্তরগঙ্গা উপত্যকা। সেখান থেকে ভাগিরথী হিমবাহ নেমে এসেছে। আর একদম বাঁ দিকে
আমাদের আগামীকালের পথের কিছুটা দেখা যাচ্ছে। পথটা কিছুটা এগিয়ে বাঁ দিকের
চক্রতীর্থ উপত্যকার দিকে চলে গেছে। ওই বাঁ দিকে থেকে নেমে এসেছে সতপন্থ হিমবাহ। আর
ঠিক যেখানে সতপন্থ ও ভাগীরথী হিমবাহ মিলেছে, ঠিক সেখান থেকেই
অলোকানন্দার উৎপত্তি। সূর্যদেব সামনের উঁচু পাহাড়ের আড়ালে গেলেন, আর উপত্যকায় সন্ধ্যার ছায়া নেমে এলো। কোথা থেকে সাদা মেঘের দল সামনের
পাহাড়গুলোকে মেঘের চাদরে ঢেকে দিতে লাগলো। অন্ধকারের গায়ে আরও এক পোঁচ পড়লো। দূরে, উত্তরগঙ্গা হিমবাহ অঞ্চলের শিখরে তখন সোনারঙ লেগেছে। অন্ধকারে মনে হয় পাহাড়গুলো
যেন একটু কাছে এগিয়ে এসেছে। হঠাৎ সেই মায়ের কথা মনে পড়ে যায়। সেই পুণ্যবতী দুঃখিনী
মা, একাকিনী এক পাথরের ওপর বসে আছেন। অলকানন্দার পাড়ে বসে আমার এই প্রাচীন, অর্বাচীন ভারতবর্ষের এক পরম্পরাকে বয়ে নিয়ে চলেছেন। কি অসীম সাহস, কে বলে নারী দুর্বল? মনে মনে সেই মন্দিরের আঙিনার সব ধুলো গায়ে মাথায় মাখি। চোখের জলে চৌকাঠের ওপর
মাথা রাখি।
রাতে শুয়ে শুয়ে ভাবি, কাল বেশি পথ নয়। তারপরেই দেখতে পাবো অলকানন্দার জন্মস্থান। সে পুণ্যস্থানও
বটে। হঠাৎ পাহাড়ে গুমগুম গুমগুম শব্দ ওঠে। কাছ থেকে দূরে সে শব্দ প্রতিধ্বনি হতে
থাকে। আমি উঠে বসি। সংগ্রামজি.....হাঁ দিদি, সাড়া দেয় সংগ্রাম, আমি বলি, ইয়ে ক্যা আওয়াজ আ রহা হ্যায়? কুছ নেহি, দিদি, আভালাঞ্চ হ্যায়, সো যাইয়ে। সে স্বর্গভূমিতে অভ্যালাঞ্চের গুমগুম শব্দ কেমন দুন্দুভির মতো
শোনায়। তারপর থেকে থেকেই সেই দুন্দুভি বাজতে থাকে। তাঁবুর চেনটা খুলে বাইরে উঁকি
দিই। আকাশে চাঁদ নেই। মাথার ওপর নক্ষত্রের নকশা কাটা আকাশ। আবছা আলোয় পাহাড়ে হেলান
দিয়ে কুয়াশারা গল্প করে ।আমি কান খাড়া করি, ওরা চুপ করে থাকে।
আবার কতক্ষন পর যেন ফিসফাস, বিষণ্নতায় ভরা। সেই অলীক নিস্তব্ধতাকে ভেদ করে কার এক গুমরোনো কান্নার শব্দ।
সেই ফিসফাসে একটু যেন উত্তেজনা, এই অলকার কথাই ধরো, জন্মের পর থেকেই বন্দিনী সে মানুষের হাতে। সারা পাহাড় জুড়ে লোভের ফাঁদ পেতেছে
তারা। পাহাড়ী নদীদের বন্দি করছে, তাদের কোমল শরীর
নিংড়ে বিদ্যুৎ তৈরি করছে, নিজেদের লোভের পূজায় নদীদের আহুতি দিচ্ছে। কি যন্ত্রনায় যে নিষ্পাপ নদীগুলো
কষ্ট পাচ্ছে। এ জীবনে ওদের আর মুক্তি মিলবে না। এই কান্নাটুকুই ওদের একমাত্র
সান্ত্বনা। আবার সব চুপচাপ। .....কিন্তু একদিন, একদিন সব
অত্যাচারীদের মতোই এদেরও চরম শাস্তি হবে, সেই আশাতেই তো অলকা
এখনও বেঁচে আছে। ওর দুচোখে যে এখনও সমুদ্রের স্বপ্ন। কী শুনছি এসব? হায় ভগবান, এরা কারা? কিছু ক্ষুদ্র লাভের আশায় মানুষ, সমগ্র মানব জাতির
জন্য কি ভয়ানক অভিশাপ কুড়িয়ে আনছে?
দিদি, উঠো, উঠে বসি। ভোর বেলা
কখন যে চোখ লেগে গেল, ইয় লো চায়। চা খেয়ে হাঁটা শুরু করি। কালকের কথা গুলো মাথার মধ্যে ঘুরে ফিরে
আসছে। পথ তো বেশি নয়, পথের নেশাটাই বেশি। অবশেষে পৌঁছে গেছি। অনেক নীচে দুই হিমবাহের সংযোগস্থলের
সিংহদুয়ার খুলে হিমালয়পুত্রী অলকানন্দার শিশু ধারা তিরতির করে বেরিয়ে আসছে।
হিমবাহ-মায়ের কোলে বসে সমুদ্রের পথের ঠিকানা জেনে নিচ্ছে সে। মায়ের আশীষ মাথায়
নিয়ে ঐতো সে এগিয়ে চলেছে। সে জানে না, পথের ফাঁদের কথা।
একটু পরেই সে সারা জীবনের জন্য বন্দি হয়ে যাবে, এটাই তার ভবিতব্য।
মানুষ তার কৃত পাপের কর্মফল স্বরূপ পৃথিবী থেকে একদিন নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে, নিশ্চিতরূপে। এটাও ভবিতব্য। আমি দেখতে পাচ্ছি, হিমবাহ-মা তাকিয়ে দেখছেন তাঁর সন্তানের চলে যাওয়া, সে আর কোনোদিন ফিরবে না তাঁর কোলে। উজানে যে আর ফেরা যায় না।
অপূর্ব বর্ণনা। মান ছুঁয়ে যায়।
উত্তরমুছুনলেখা পড়তে পড়তে আরও একবার মানা থেকে লক্ষ্মীবন হয়ে সেই অলকাপুরী , যা কিনা অলকানন্দার উৎসস্থল, তা ঘুরে এলাম | মন ছুঁয়ে যায়, বার বার যেতে ইচ্ছে করে |
উত্তরমুছুন