যদি ধরে নেওয়া যায় যে আর
পাঁচটা ভাইরাস ঘটিত রোগের মতো করোনা ও সময়ের সাথে বিদায় নেবে, তবে তো খুবই ভাল কথা;
আর যদি না যায় তাহলে ? অথবা যদি চলেও যায়, তাহলে কোথায় যাবে, মানে যেতে পারে ? আমেরিকা
না চীন, নাকি মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি, নিদেন কাছের চাঁদেও যেতে পারে; যেখানে পারে
যাক আমরা একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচি, উঃ, উফ! ওরে একটু বাতাস কর, দেখি করোনা কি দিয়ে গেল ? ওরে, কে আছিস, জমা খরচের খাতাটা
একটু নিয়ে আয়, দেখি।
আহা, পেয়েছি এক ছুটি-ঋতু। সারাদিন অখণ্ড অবসরে
খবরের কাগজের প্রতিটা শব্দ ধরে ধরে চিবিয়ে তার সব রস নিংড়ে বার করছি। হুঁ হুঁ বাবা, মনের খুব পুষ্টি হচ্ছে । মাঝে মাঝে বদহজমও হচ্ছে, তবে কিনা বাড়িতেই আছি তো, সামলে নিচ্ছি । আহা, কত খবর, রোজ সকাল থেকে
রাত পর্যন্ত একই খবর বার বার পড়তে থাকি। তারপর একদিন হঠাৎ এক আশ্চর্য জিনিস খেয়াল করি। মার্চ
মাসের করোনা সংক্রান্ত খবরের থেকে আজকের দিনের কাগজের করোনা সংক্রান্ত খবর বিলকুল আলাদা। যেমন তখন খবরের কাগজগুলো
লিখে ছিল করোনা ভাইরাস চীন বানিয়েছে। সেই নিয়ে চারদিকে খুবই উত্তেজনা। সাবধানে সাবধানে সব
বাজার, অফিস যাওয়া আসা। তার মধ্যেই আবার হাত
ধোয়া শুরু হলো। তারপর বিদেশ থেকে সব বাড়ি ফেরানো শুরু হলো। ঘরের ছেলেরা ঘরে ফিরে
আসতে লাগলো।
তারপর আরেক দিনের কথা। ততদিনে করোনা দেশবিদেশে
ছড়িয়ে পড়েছে। আমাদের দেশে কেরালাতেও প্রথম রোগী চিহ্নিত করা গেছে। সরকারিভাবে সমস্ত রকম
সতর্কতা জারি হয়েছে। তারপর, করোনা এক শুভক্ষণে কি করে যেন কলকাতায় পৌঁছলো। তারপর, সে এক ভারী
গোলযোগ উপস্থিত হলো। আবার খবরের কাগজ মারফত জানা গেল যে করোনা সোজা নবান্নে পৌঁছে
গেছে। কি আপদ!
পরের দিন সকালে চায়ের কাপ
নিয়ে সবে কাগজটার প্রথম পাতায় চোখ রেখেছি, এক উচ্ছপদস্থ্য আমলা তার বিদেশ থেকে আগত করোনা পজিটিভ পুত্রকে নিয়ে নবান্নে
বেড়াতে এসেছিলেন। তারপর এঘর ওঘর সব ঘর বেড়িয়ে নবান্ন থেকে সরকারি গাড়িতে করে
বিভিন্ন জায়গায় কাজ সারতে সারতে…সারা
হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেল, চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। এইসবের মাঝে চা টাও
ঠান্ডা হয়ে গেল।
তারপর মিডিয়াগুলোতে ভীষণ
রাগারাগি, গালাগালি চললো। তারপর, সময়ের স্রোতে
সব স্মৃতি ভেসে গেল। আহা, বেশ
বেশ।
এদিকে, করোনা কেরালা ছেড়ে
ধীরে ধীরে মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক,
দিল্লি ছুঁয়ে বাকি রাজ্যগুলোতেও পৌঁছে গেল। সরকারি নির্দেশে মোমবাতি জ্বালানো হলো, কাঁসী বাজানো হলো। করোনা গেল না। দেশজুড়ে বাজিও ফাটানো
হলো। এরমধ্যে শোনা গেল ,
গোমূত্রে করোনা সারবে। অতি সাবধানী মানুষজন সেটাও পান করে হাস্পাতালে ভর্তি হলো।
আবার সরকারি কড়া নির্দেশ
জারি হলো, গোমূত্র নয়, অসুস্থ হলে
ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। তারপর, লকডাউন হলো; যে যার সামর্থ অনুসারে চাল ডাল কিনে ভয়
মিশ্রিত সুখে শান্তিতে বাড়িতে ঢুকে দোর দিলো।
কি আশ্চর্য, গল্পটি ফুরোলেও নটেগাছটি তো মুড়োলো না, বরং ডালপালা ছড়িয়ে সে মাথাতেও বাড়তে লাগলো।
সারা দেশে কল-কারখানা বন্ধ
হলো। কর্মচারী ছাঁটাই শুরু
হলো। প্রচুর মানুষ
কর্মহীন হলো। কর্মহীন মানেই বেতন বন্ধ। কিন্তু, বেতনহীন হওয়া মনে তো ক্ষুধা
তৃষ্ণাহীন হওয়া নয়। তাই ক্ষুধায় তৃষ্ণায় সেই মানুষগুলো নিদ্রাহীন হলো। তারা ভয়ে দিশাহারা
হয়ে গেল। তাদের শেষ আশ্রয়স্থল
বাড়ি, তারা বাড়ি ফিরতে চাইলো। তারপর, দুরদর্শন আর
খবরের কাগজগুলোর মিলিত প্রচেষ্টায় আশ্চর্য নির্মম খবর চিত্রসহ পরিবেশিত হতে লাগলো, দিনের পর দিন। তারপর, সেই দুঃস্বপ্ন
আমরা চাক্ষুষ করলাম। রেললাইনে ট্রেন চলছে না, লকডাউনে ঘরমুখী মানুষ সেই লাইনের উপর দিয়ে হাঁটছে। দু-দশ মাইল নয়, কয়েকশো মাইল; হাতে ব্যাগ, কোলে শিশু। আচ্ছা, বলুন
তো, কত কত মাইল হাঁটলে
তাকে মানুষ বলা যায় ? কেউ বলতে পারেন ? বড়জোর দুটো রুটি আর এক বোতল জল সম্বল করে দিনে হেঁটে রাতে ক্লান্ত শরীরগুলো
রেললাইনকেই বিশ্রামের আশ্রয় করেছে। রেলের লাইনের ওপরেই মানুষগুলো ঘুমিয়ে পড়েছিল। পরেরদিন দেশের সব সংবাদমাধ্যমে
প্রথম পাতায় রেললাইনের ওপর ছড়িয়ে থাকা তাদের চটি আর রুটির ছবি দেখে সারা দেশ বাকরুদ্ধ
হয়ে গিয়েছিল। তারা হয়তো স্বপ্নই দেখছিল বাড়ির, কে বলতে পারে ? যে ট্রেন
লকডাউনের জন্য চলেনি, সেই ট্রেনই রাতের অন্ধকারে তাদের না-ফেরার
দেশে পৌঁছে দিলো! আর তারা কোনোদিন বাড়ি ফিরবে না।
তার মাঝে, গোদের ওপর বিষফোঁড়া, আমফান! উঃ, প্রকৃতি এত
জ্বালাতনও করতে পারে।ও এদিকে আসবে না, হয় উড়িষ্যা যাবে নাহলে
সুন্দরবন ছুঁয়ে বাংলাদেশ চলে যাবে, বরাবর দেখে এসেছি। কি বললে ? আবহাওয়া
দপ্তর বলেছে, এবারের এই ঝড়টা কলকাতার ওপর দিয়েই
যাবে। যতই বলুক, ফোনির বেলাতেও বলেছিল। অফিস ছুটি হয়ে গিয়ে
ছিল, ঐরকম কিছু একটা হবে। তারপরে আমাদের সব ইতিবাচক
ভাবনায় নোনাজল ঢেলে, আমফান কলকাতার
ঝুঁটি ধরে নেড়ে দিয়ে গেল। বিদ্যুৎ নেই, জল নেই, গাছ নেই আরও কত কি নেই নেই। সারা কলকাতা শ্মশানভূমি। কয়েক হাজার গাছ পড়ে
গেল। চারদিক লণ্ডভণ্ড। তারপর জানা গেল, সুন্দরবনের
চরম ক্ষতি হয়ে গেছে, শেষ হয়ে গেছে সুন্দরবন। যাক গে, কলকাতাকেই
বাঁচানো যাচ্ছে না, তো সুন্দরবন। সব খবরের কাগজ কোম্পানিগুলোর
কপালে ভাঁজ পড়ে গেল, এই লকডাউনের
মধ্যে এত খবর কি ভাবে
ছাপা হবে, ছাপার কাগজ বাড়ন্ত যে। সংবাদ মাধ্যমে দেখতে
পেলাম সবাই কেমন সবাইকে বকতে লেগেছে। এই বকাবকি, দোষের চাপান-উতরের মাঝে হেলে পড়া কলকাতাকে আবার সোজা করা হলো। কলকাতা আবার সেজেগুজে
করোনার সমস্যা নিয়ে দিনযাপনের বারমাস্যা গাইতে লাগলো।
সেই নটেগাছটা মাথায় বেশ উঁচু
হয়েছে। তার উপরে উঠে চারপাশটা
বেশ দিব্বি দেখা যায়। সেই গাছের অনেক ওপর দিয়ে উড়োজাহাজে করে শত শত মানুষ প্রতিদিন
দেশে ফিরে আসছে। খবর-ব্যাবসায়ীরা সেখানেও উঁকি মেরে দেখে। বিমানবন্দরগুলোয় আরেক
চিত্রনাট্য। বিশ্বের সব থেকে পুরাতন অথচ চির নতুন সেই বিভাজন, গরিব ও ধনীর পাঁচালি। ধনীর জন্য স্যানিটাইজার, গরিবদের গায়ে ক্লোরিনের জল ছেটান হলো। মানুষের প্রতি মানুষের
কি অপূর্ব গণতান্ত্রিক ভালোবাসার প্রদর্শন।
রোজ এই মনোরম ছুটির আবহাওয়ায়
খবর বিক্রেতারা পসরা সাজিয়ে এই সব গুরুত্বপূর্ণ
খবর বিক্রী করতে লাগলো। যারা ওই দিন-আনা-দিন-খাওয়া মানুষ নয়, তারা আহা, উঁহু, কি কষ্ট, চোখে দেখা যায় না, বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে পড়লো।
এরপর, করোনা নাটক আরও চমৎকার। ওই যে পরিযায়ী শ্রমিকগুলো, যাদের ধৈর্য্য বলে কিছু নেই, তারা মৃত্যুর হাত শক্ত করে ধরে করোনাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে যে যার বাড়ির দরজায়
শেষ পর্যন্ত পৌঁছে গেল; কিন্তু না, বাড়িতে ঢুকতে পারলো না। কারা যেন কানে কানে
ফিসফিস করে বললো, ওরা সব করোনা
পজিটিভ। অমনি, সেই
ফিসফাস আর রইলো না। চারদিক কাঁপিয়ে সেই শব্দ, ঠিক, ঠিক, ওই গরিবগুলোই
তো করোনা ছড়াচ্ছে। কতোদিন স্নান করেনি, জামাকাপড় ছাড়েনি, ওই ওদের জন্যই তো রোগ ছড়াচ্ছে।হতে
পারে।
কিন্তু কথা হচ্ছে যে, যারা বিদেশ থেকে ফিরছে তাদের এই বিষয়বস্তু থেকে
দূরে রাখা হয়েছে। কেউ এই বিষয়ে কোনো কথা বলছে না। কেউ এ কথাও বলছে না
যে এই অসুখ গরিব এই লোকগুলো কোথায় পেলো ? তারা তো কেউ বিদেশে যায় নি, আর করোনাও তো ভারতবর্ষে
জন্মায় নি!
যাই হোক, সে………ই যে শ্রমিকগুলো,পনেরদিন নির্বাসন পেরিয়ে করোনায় না মরে, না মরে বলছি
কারণ, কোনো সংবাদ মাধ্যমে এই খবর ছাপা হয় নি, যে যার বাড়ি ফিরে
গেল।
এইবার, এক আনন্দ সংবাদ পাওয়া গেলো। লকডাউন উঠে যাচ্ছে। কেন লকডাউন হয়েছিল
ভুলে গিয়ে, আহল্লাদে ষোলখানা হলাম। উল্টো-কুলোর হাওয়া দিয়ে করোনা এবং করোনা ভীতিকে মৌসুমী হাওয়ায়
ভাসিয়ে আবার চায়ের কাপ নিয়ে বসলাম। তারপর, বাঁ হাত দিয়ে মুখের পট্টি সরিয়ে চায় চুমুক দিলাম। এই করোনার জ্বালায় চা খাওয়া
প্রায় বন্ধ হয় আর কি! বলুন তো, চা খাবো
না আমরা, খাবো না আমরা চা ? ঐতো, সেই নটে
গাছের ডালপালাগুলো দেখা যাচ্ছে, ছোট ছোট ফলও ধরেছে। আচ্ছা, নটেফল কি খায় ?
এই তুই কে রে ? বাড়িতে ঢুকলি কি করে ?
আজ্ঞে, আমি করোনা।
আমি যাই নি, যাচ্ছি না, যাবোও না।
ভাবনার স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশ
উত্তরমুছুন