রবিবার, ২৫ অক্টোবর, ২০২০

কবিতা ২

 জঠরে দিয়েছি ধরা, ছায়াপথ ছেড়ে, 

সেই থেকে নরক যাপন। নাড়িতে নাড়িতে বাঁধা।

কত কৌতূহলী মন, সুখের আঁকি বুকি কাটা,

সূর্য রশ্মি যেমন খেলা করে নারকেলের পাতায়।

তারপর একদিন বহু রক্তপাতে,

পৃথিবীর ধূলি হয় লাল, হায়,

সেই প্রাণ অন্ধকারে, ডাস্টবিনে। শুধু মেয়ে 

বলে। আবার ফিরে যাই সেই ছায়াপথে।

শনিবার, ১৭ অক্টোবর, ২০২০

কবিতা ১ !

 এক দৃষ্টে চেয়ে থাকে শান্ত হয়ে,

শান্ত হতে হতে ,পলক পড়ে না আর,বহুদিন।

গাল বেয়ে জল গড়িয়ে নামে না আর।

নদী বুঝি শুকিয়েছে,নাকি অন্ত সলিলা,

বসে থাকা ,চুপচাপ শুধু বসে থাকা।

অনেক বছর আগে এক শীতের সন্ধ্যায়,বিস্বস্ত

এক সম্পর্কের অবিশ্বাসী শ্বাস শুধুই বিষ উগরে 

ছিল, গোপনে।

সেই নীল লাভা তার যাত্রা পথ সম্পূর্ণ করেছিল

অসীম নিয়মানুবর্তিতায়।

সব শেষে ধোঁয়া ছিল অল্প আর ছিল জীবনব্যাপী ছাই।

সময়ের ক্যানভাসে আজ তার নেই কোনো অস্তিত্ব।

শুধু শনশন হাওয়া পাতা উড়িয়ে নেয়।।যেন,

তার চঞ্চল পায়ের শব্দ।

আজ আর কেউ নেই,শুধু আছে আশা,

তাকে ছুঁয়ে শুধু বেঁচে থাকা।

মঙ্গলবার, ১৩ অক্টোবর, ২০২০

এক অজানা পথের গল্প !

 

মুন্সিয়ারী এসে পৌঁছেছি। গন্তব্য পঞ্চচুল্লি বেসক্যাম্প। এর আগেও বেশ কয়েকবার এসেছি মুন্সিয়ারী। পঞ্চচুল্লি শিখররাজির সৌন্দর্যে মোহিত হয়েছি বারবার। সূর্যাস্তকালে পঞ্চচুল্লি অপার্থিবরূপ ধারণ করে। কতবার ভেবেছি যাব পঞ্চচুল্লি বেসক্যাম্প। এবার সেই স্বপ্ন সার্থক হতে চলেছে

পথ চলার রসদ কেনাকাটা সহ সব প্রস্তুতি সম্পূর্ণ।  রাতে খাওয়ার পরে আবার একবার মুঠোফোনে অন্তর্জালে আড়ি পাতলাম। বেসক্যাম্প থেকে পঞ্চচুল্লি। একই ছবি বারবার দেখা পুরোনো অভ্যাস। পঞ্চচুল্লি ছাড়া আর কি কি দেখা যাবে? রাজরম্ভা, হংসলিঙ্গ  চূড়া দুটি দেখা যায়

পঞ্চ চুল্লি ১, , , , , তারপর রাজরম্ভা। একী , পঞ্চচুল্লির  চারটে  চূড়া দেখা যাচ্ছে! আর একটা কই ? বেসক্যাম্পের ছবিটা বারবার দেখছি, কিন্তু একটা চূড়া তন্নতন্ন করেও দেখতে পেলাম না। অথচ, মুন্সিয়ারীর হোটেল থেকে জানালার বাইরে পাঁচটি শিখরই ঝকমক করছে। গাইড কে ফোন করলাম। কেউ কিছুই বলতে পারছে  না, কি ঝামেলায় পড়া গেল! এখন কি করি, এই চিন্তায় ঘুম পালাল। অনেক কষ্টে নিজেকেই আয় ঘুম, আয় ঘুম বলে ঘুম পাড়ালাম

সকালে উঠে আবার সেই পাঁচটি শৃঙ্গ। আশ্চর্য ব্যাপার বেসক্যাম্প থেকে একটি হাওয়া! যাই হোক, ধারচুলায় পৌঁছলাম। SDM অফিস থেকে অনুমতি পত্র যোগাড় করে ছোট একটা গাড়ি ধরে গাড়িপথে দার গ্রাম। এই পথের গাড়িপথ এই গ্রাম পর্যন্তই। হাঁটা শুরু, মাথার মধ্যে পঞ্চচুল্লির হারিয়ে যাওয়া চুড়াটা। হাঁটছি হাঁটছি; ধীর ধীরে। বাঁ পায়ের গোড়ালিটা ব্যথা করেছে। ভুলেই গেছিলাম দিন দুয়েক আগে বাঁ-পাতা মোচকে ছিল। ফুলে গিয়েছিল, তার সাথে ঝনঝনিয়ে ব্যথা। চিন্তা ছিলই কি করে হাঁটব। এবার ছেলে ছিল সাথে। ওর টেন বোর্ডের পরীক্ষা শেষ হয়েছে সবে। সকাল বিকাল ব্যথা কমানোর  ওষুধ খেয়ে ব্যথাটা অত মালুম হচ্ছিল না। কিন্ত পাহাড়ী পথে আবার ব্যথাটা জানান দিচ্ছে। পৌঁছলাম সোবলা। আর্মি ক্যাম্প, নদীর ধারে। বিকেলবেলা ফৌজী চা খেলাম। যে অফিসার ছিলেন, ভাল মানুষ। আমাকে অল্প খোঁড়াতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন। জানা গেল তিনি ডাক্তারও বটে। তিনি ব্যথা কমানোর জন্য ফৌজী ওষুধ দিলেন। আমার আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেল। রাতে ফৌজী খানায়  আপ্যায়ন করেলেন। পঞ্চচুল্লির কথা জিজ্ঞেস করলাম। দূঃখের  সাথে জানালেন ওটা সম্পর্কে তিনি কিছুই জানেন না। আসলে ওটা ওনার সরকারী কর্মের আওতার মধ্যে পড়ে না কিনা, তাই। আমি শুনে খুব একটা খুশি হলাম না, কিন্তু শুভরাত্রি জানিয়ে শুতে গেলাম

আজ যাব নাগলিং হয়ে বালিঙ। নাগলিং থেকে বালিঙ এর রাস্তায় চড়াই উতরাই কম, সোজা রাস্তা। হাঁটছি, ছবি তুলছি, ভালই লাগছে, কিন্তু মনের ভিতর খচখচ সেই পঞ্চচুল্লি। নদীর ধারে নামছি, কখনও রাস্তা ধসে গেছে বলে, কখনও বা জঙ্গল পেরচ্ছি। সারাদিন মেঘ রোদের লুকোচুরি। বালিঙ পৌঁছতে প্রায় তিনটে বাজল। আবার মিলিটারী চৌকিতে যেতে হলো। এক কপি পরিচয়পত্র জমা করতে হলো। অফিসার-ইন-চার্জ হাসতে হাসতে বললেন এখানে সবাই পরিবার নিয়ে আসে ট্রেক করতে, মাঝে মাঝে বাবা-ছেলেও আসে, কিন্তু মা-ছেলে? না ম্যাডাম, এই প্রথম দেখলাম। আমিও হাসলাম। তারপর, সেই মধ্যেকার পোকাটা ওনার সামনে মেলে ধরলাম। পঞ্চচুল্লি বেসক্যাম্প গেছেন? হ্যাঁ, আমাদের জওয়ানরা ওদিকে যায়। বেসক্যাম্প ছাড়িয়েও আমাদের আর্মি ক্যাম্প আছে। কিন্তু, মজার কথা কি জানেন ম্যাডাম, ওখান থেকে ৪টে চূড়া দেখা যায়, ১ টা দেখা যায় না। এই তো হতে চাঁদ পেয়েছি! তাহলে ওটা কোথা থেকে দেখা যায়? হা হা , যাবেন? পারবেন? ‘বলুন না’, আমি বলি, ‘এখান থেকেই যেতে হবে?’ চাফা হিমবাহ, আসল নাম উত্তর বালাতি হিমবাহ। আমি অভিভূত হয়ে যাই। কিন্তু, আবার অনুমতি পত্রয়েল ঝামেলা। উনি বললেন, আগে বেসক্যাম্প ঘুরে আসুন। তারপর দেখছি

এর পরের কাঠগুলো সংক্ষেপে বলি। আমি পঞ্চচুল্লি বেসক্যাম্প গেলাম ওর ফিরে এলাম। আবার সে অফিসারকে খুঁজে বার করলাম এবং অনুমতি পত্রের জন্য দুই হাত পাতলাম। “কেউ যায় না, ম্যাডাম, এত সুন্দর বেসক্যাম্প ঘুরে এলেন, বাড়তি কিছু নেই। কোন লোকজন জনবসতিও নেই।”

আমাকে একটু অনুমতি দিন না, আমি দেখতে চাই। “সঙ্গে ছেলে, দেখে মনে হচ্ছে, নাবালক। আমরা এতটা রিস্ক নিতে পরি না” আমিও নাছোড়। ঠিক আছে, যতটা পারব যাব, তারপর ফিরে আসব। আমার বেসক্যাম্প পথের গাইড ছিল উত্তরাখণ্ডের ছেলে। শেষমেষ ওকেই শিখণ্ডি খাড়া করি। ওর সব কথা শুনবো, ও যেখান থেকে ফিরে আসতে বলবে, ফিরে আসব

হা হা হা হা –বড়ী জিদ্দি হ্যায় আপ তো...সামহালকে জাইয়েগা। আকে হামসে মিলিয়েগা। লেকিন ইয়াদ রহে খতরা নেহি উঠানা হ্যায়, ব্যস

আজ ঘুম থেকে উঠেই তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিলাম। ক্যাম্পের পাশ দিয়ে আসার সময় দেখা হলো ভদ্রলোকের সাথে, wish করলেন। প্রথমে খানিক চড়াই  ভেঙে উঠলাম জঙ্গলের ভিতর দিয়ে। পথ বলতে ঐ। ব্যস, রাস্তা বন্ধ। সামনে একটা বিশাল পাথরের চাট্টান । হয়ে ভগবান, এবার কি করি? এখান থেকেই ফিরতে হবে নাকি? কিছুতেই নয়। মনে মনে স্থির করি, যেতেই হবে, যাবই। তারপর, হিমালয়কে প্রণাম করে, লোপাকে সাবধান করে, সেই পাথরের ওপর পা রাখলাম। তারপর, এক পা, এক পা করে টিকটিকির মতো পাথরটাকে কোনাকুনি ভাবে পর করলাম। ওপরের পথও জঙ্গল, পথ নেই। ভুল বললাম, জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হাঁটা। শুধুই চড়াই। অনেক চলে, একটা সবুজ বুগিয়ালে এসে, পৌঁছাই। সেই চড়াই পথ বুগিয়ালের ভিতর দিয়ে চলে গেছে। সবুজে সবুজ চারপাশ, তার মধ্যে প্রিমুলার গালিচা

দেখা যাচ্ছে সামনের পর্বতমালা। বাঁ দিকে নাগলিং রেন্জ, একদম ডান দিকে পঞ্চচুল্লির হারিয়ে যাওয়া চূড়া। চলতে চলতে প্রিমুলার গালিচা পেরিয়ে উঠে এলাম আরও উঁচুতে। এগিয়ে চলেছি তাকে আরও কাছ থেকে দেখবো বলে। এক স্বর্গীয় উপত্যকা। ঝোপঝাড় আলো করে ফুলে আছে। হালকা বেগুনি রডোডেনড্রন। পিছনে নাগলিং রেন্জ। ডানদিক থেকে নেমে এসেছে ছোট ছোট হিমবাহ। নদীর ধারা জমে বরফ। সেই সবুজের মাঝে সাদা হিমবাহের  আলপনা, নীল আকাশে সাদা মেঘের ওড়াউড়ি । এক স্বপ্নের জগতে। দূরে ইয়াক  চরছে। ক্রমে, জমে যাওয়া হিমবাহ অঞ্চলে প্রবেশ করলাম

তারপর, দূর থেকে যাকে দেখে আশ মেটে নি, যার অপেক্ষায় এত পথ পেরলাম, তার সাথে দেখা হলো। সেই বেসক্যাম্প থেকে হারিয়ে যাওয়া পঞ্চচুল্লির একচূড়া। স্বমাহিমায় দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু, আমরা এত কাছে চলে এসেছি যে, না কাছে এসেছি বলার থেকে কোলে উঠেছি বললে ঠিক বলা হবে। কারণ, যে হিমবাহটার  উপর দাঁড়িয়ে আছি সেটা ঐ চুড়ার উপর থেকে সটান নীচে নেমে এসেছে। যার ফলে মাথা উঁচু করেও আর ভাল দেখা যাচ্ছে না। অনেকক্ষণ পর আমাদের কোল থেকে আবার নামিয়ে দিলেন। অপূর্ব এক অভিজ্ঞতা!

ফিরতি পথে অভ্যাসবসে পিছন ফিরলাম। হাসিমুখে বিদায় দিলেন। প্রণাম জানলাম। শেষ মোড়টায় এসে আবার পিছন ফিরি। এক ঠান্ডা হাওয়ার ঝলক, ফিস ফিস করে বলে, ‘আবার এসো’

রবিবার, ৪ অক্টোবর, ২০২০

আঁধার পেরিয়ে

 

খুকি, দেখতো কে এলো? যাই মা, ঘরের ভিতর থেকে রুপা সাড়া দেয়। ওমা, টোটোন দাদা এসেছে । মা বেরিয়ে আসেন, 'কতদিন পরে এলি, বাড়িতে সব ভালো তো?' হ্যাঁ, সবাই ভালো আছে। দুপুরে খেতে বসে পুরোনো দিনের কত কথা, কত গল্প, শেষই হতে চায় না। কি যেন একটা বলবি বলেছিলি, মা জিজ্ঞাসা করেন। ‘আমি জ্যোতিষবিদ্যা নিয়ে পড়াশুনা করছিলাম, পরীক্ষাও দিয়েছিলাম। জানো মামী, আমি ফার্ষ্টক্লাস পেয়েছি’।তাই নাকি, সে’ত খুব ভালো কথা। তা বোনের হাতখানা একবার দেখে দিস দেখি। পড়াশুনায় মন নেই যেন।

কৈ, তোর  হাতখানা দেখি একবার। মনে একরাশ কৌতূহল নিয়ে সে হাতটা এগিয়ে দেয়। মায়ের কাছে রাশি লগ্ন সব  জানতে চায়। আর ও অবাক চোখে তাকিয়ে দেখে, দাদা তার কত কি জানে। রাতের আকাশের সব গ্রহ তারাদের কাজ কর্ম সব জেনে ফেলেছে। কত শক্ত, কত মোটা সব বইগুলো, আগেরবার পিসির বাড়িতে গিয়ে সে দেখেছিল। সম্বিৎ ফেরে মায়ের কথায়, 'কিরে কিছু বলবি না', টোটোন দাদা গম্ভীর মুখ করে বলে, জীবনে অনেক কষ্ট ওর, গ্রহযোগে সংসারও হবার নয়, তার মধ্যে আবার..'.....'কিরে থামলি কেন' ,' না মানে কি বলবো ভাবছি, হাতে একটা স্পষ্ট হারেম যোগ দেখতে পাচ্ছি।' মা একদম চুপ করে বসে থাকে। এত কথার মধ্যে ও জীবনের কষ্টের কথাটা বুঝলো। বাকি কথাগুলো বুঝতে পারেনি। দশ এগারো বছর বয়সে কতটাই বা বোঝা যায়? সন্ধ্যাবেলায় দাদা বাড়ি চলে গেল। সাথে করে বাড়ির খুশিভাবটাও যেন নিয়ে গেল।

বাড়িটা আশ্চর্য ভাবে বদলে যেতে লাগলো। খেলাধুলো বন্ধ হয়ে গেল তার। সে হঠাৎ বড় হয়ে গেছে। সব সময় শাসন। এটা করবে না, ওর সাথে মিশবে না।  কিছুই বুঝে উঠতে পারে না সে। মাস্টারমশায়ের কাছে পড়তে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। একজন দিদিমণি ঠিক করা হয়েছে, বাড়িতে এসে পড়াবে। বার্ষিক পরীক্ষা শেষে টোটোন দাদাদের বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিল সবাই মিলে। টোটোন রূপার পিসতুতো দাদা। পিসি আর মা কি যেন কথা আলোচনা করে। ওকে দেখে চুপ করে যায়। কি এক অজানা কারণে স্বাভাবিক আচরণের তাল কেটে যাচ্ছে বারবার। না, এবারে যেন আগের বারের মতো আনন্দটাই হলো না। বয়স বাড়তে থাকে তার। কি যেন এক কারণে সব আত্মীয় স্বজনের সাথেই দূরত্ব বাড়তে থাকে। দাদা দিদির ফিসফাস করে। হাসাহাসি করে মুখ টিপে।

সবে মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে। ও মনে মনে ঠিক করে রেখেছে, এই ছুটিতে মামার বাড়ি, পিসীদের বাড়ি, জেঠুর বাড়ি সব জায়গায় যাবে।  কিন্তু বাস্তবে কোথাও যাওয়া হয়ে ওঠে নামা ওকে কোথাও যেতে দিলো  না।  নিজের বোনের সাথেও একটা দূরত্ব যে তৈরি হয়েছে, সেটা বেশ বুঝতে পারে।

রেজাল্ট বেরোলে এগারো ক্লাসে ভর্তি হয়। ক্লাসের মেয়েদের সাথেও মন খুলে মিশতে পারে না। অনেকদিনের অভিজ্ঞতায় সে বুঝতে পেরেছে  যে সবাই ওকে এড়িয়ে চলতে চায়। বাড়িতেও সমবয়সী ভাইবোনদের সাথে দূরত্ব যেন সীমাহীন। মায়ের চোখ মুখেও সবসময় একটা চাপা ভয়, কোথাও যেন একটা অবিশ্বাসও কাজ করছে। বার ক্লাসে পড়ার সময় একটা বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে আসে কে যেন। পাত্রপক্ষ কোষ্ঠি বিচারের কথা বলে। মা বেঁকে বসেন। মা  গজগজ করেন, আজকালকার যুগেও এত কুসংস্কার, সাফ বলে দেন, কোষ্ঠি নেই। কিন্তু রূপা তো জানে যে কোষ্ঠি আছে। একদিন আলমারি থেকে সেই কোষ্ঠি সে বার করে আনে। মা দেখতে  পেয়ে ছুটে আসেন।  চুলের মুঠি ধরে বলেন, ' পোড়ারমুখী, নিজের হাতে নিজের পায়ে কুড়ুল মারছ?'  ততক্ষণে রুপার কাগজখানা পড়া হয়ে গেছে। লেখাগুলোর মানে আজ সে বোঝে। মাকে বলে, 'কেন এত ভাবছো মা, তুমি তো এসব মান না।' মা বলেন, গ্রহ নক্ষত্রের বিচার ভুল হয় না রে।'

দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের আনা সেই পাত্রের সাথে বিবাহ সম্পন্ন হয়ে যায়। বাবা মায়ের মাথা থেকে যেন পাথর নেমে যায়। নিকট আত্মীয়দের ভালোবাসায় সেই  ভীষণ গোপন কথা তার শ্বশুরবাড়িতেও পৌঁছলো। তারপর শুরু হলো তার বাবা মায়ের নিন্দে। তারা নাকি সব জেনেও তাদের সর্বনাশ করেছে। চুপ করে থাকে সে, কিই বা উত্তর দেবে? কে বলে বোবার শত্রু নেই? একবার ভাবে বাবা মায়ের কাছে চলে যাবে, পরক্ষণেই বাস্তবে ফেরে। ওখানে ফিরলেও এই সমস্যার সুরাহা হবে না। মনে ভাবে, না, কোনো প্রতিবাদ সে করবে না।....কিন্তু একদিন আর পারলো না সে, তাকে যেদিন দুশ্চরিত্রা বলা হলো, সেই দিন সে আর পারলো না। সেই দিন ভীষণ অপমানে সে তার একমাত্র ভরসার জায়গা, বাবার বাড়িতে ফিরে এলো। সবকথা শুনে মা আবার টোটোন দাদাকে ডেকে পাঠালো, যদি প্রায়শ্চিত্ত করে দোষ কাটানো যায়। দাদাকে সামনে পেয়ে মা একেবারে ভেঙে পড়েন, কি হবে এবার? মাকে সান্তনা দিয়ে সে বলে, যা হবার তা হয়েছে, ওকে শ্বশুরবাড়িতে পাঠাবার ব্যবস্থা করো। নাহলে.......নাহলে কি......

এতক্ষণ সব শুনছিলো সে দাঁড়িয়ে, এবার রূপা কথা বলে, 'না আমি আর ওই বাড়িতে ফিরবো না’ 'ফিরতে তোমায় হবেই,' মা চিৎকার করে ওঠে।  রূপা শান্ত স্বরে বলে, 'মা,তোমরা সেই ছোটবেলা থেকে আমাকে এইরকম একটা ভুলের জালে বেঁধে ফেলেছো কেন? আমার সেই না বোঝার বয়স থেকে এই কথা গুলো চর্চা করে করে প্রায় সত্যতে রূপান্তরিত করেছ। আর এর ফলে যে একটা জীবন শেষ হয়ে গেল সেটা তোমাদের চোখ এড়িয়ে গেল কি করে?  বিয়ের সময় তুমি কোষ্ঠি দেখাতে চাও নি, কুসংস্কার বলেছিলে অথচ ওই কাগজটাকে তুমি যে বিশ্বাসে জড়িয়ে ছিলে তাকে কি বলে, মা? কাগজটার বদলে যদি নিজের মেয়েকে বিশ্বাস করতে তাহলে আমার জীবনটা তো নরক হয়ে যেত না। আমায় তুমিই বিশ্বাস করতে পারো নি, বাইরের লোক কিভাবে বিশ্বাস করবে?' তারপর দাদাকে দেখিয়ে বলে, 'ওর যদি এতই জ্ঞান তাহলে ও নিজের ভাগ্য দেখতে পায় না কেন? ওর চাকরি হয় নি কেন, কেন লোকের মনে অন্ধবিশ্বাসের বীজ বুনে ওকে সেই ফসলে নিজের দিন গুজরান করতে হয়? বলো মা, বলো।' মা মাথা নিচু করে বসে থাকেন।  দাদা ওকে বোঝাতে আসে। কিন্তু না,আজ সে আর কারুর কথা শুনবে না। অনেক সহ্য করেছে সে। আজ এর প্রতিবাদ তাকে করতেই হবে। নাহলে তাকে আরো কোণঠাসা হয়ে পড়তে হবে। খবরের কাগজে প্রায়ই দেখা যায় আদিবাসী সমাজে একটি মেয়েকে ডাইনি চিহ্নিত করে বিভিন্ন অত্যাচারের ঘটনা, এমন কি তাকে হত্যা করতেও তারা পিছপা হয় না।  প্রথমে তাকে সমাজ ও পরিবার থেকে সুকৌশলে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়, তারপর মেয়েটি একদম একা........যেমন খুশি অত্যাচার করো। সেও তো এখন একদম একা। আর তার এই পরিস্থিতির জন্য তো কোনো অশিক্ষিত আদিবাসী সমাজ দায়ী নয়।

ছোটবেলা থেকে সে একাই ছিল। আর আজ তো আরও বেশি একা। চাকরিও করে না। বাড়ির বাইরের জগৎ তার একেবারেই অপরিচিত। বাড়ির একটা ঘরে সে একাই থাকে। সেই কোষ্ঠিটা রোজ একবার করে পড়ে। খুব আশ্চর্য লাগে তার, এই সাধারণ একটা কাগজ তাকে তার বাবা, মা সবার থেকে আলাদা করে দিয়েছে। জ্যোতিষশাস্ত্র কি এতোই নির্ভুল? নিজের সন্তানের থেকেও তার প্রতি বিশ্বাস বেশি হতে পারে?

একদিন তার এক বান্ধবী দেখা করতে এসে। রূপা তাকে সব কথাই খুলে বলে, খালি কোষ্ঠীর কথাটা বলে উঠতে পারে না। ওর বন্ধু, মায়া, ওকে বলে, ওদের এক পারিবারিক শুভানুধ্যায়ী আছেন, যিনি হাত দেখতে পারেন।  রুপার মাথায় একটা বিদ্যুৎ খেলে যায়। সে যেতে রাজি হয়ে যায়। ওরা নির্দিষ্ট দিনে সেই ভদ্রলোকের বাড়ি গিয়ে পৌঁছয়। তিনি নিজেই এসে দরজা খুলে দেন। সাদা ধুতি, সাদা ফতুয়ায় এক শান্ত, সৌম্য অতি বৃদ্ধ মানুষ। পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে দুজনে। মায়াই কথা শুরু করে। তিনি  একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন রূপার দিকে, যেন কি একটা পড়ছেন। একমুখ হাসি নিয়ে বলে ওঠেন, যে দরজাটা বন্ধ হয়ে গেছে সেটা আর খোলার দরকার কি? জীবনের দরজার কি অভাব? কখন কোন দরজা কার সামনে খুলে যাবে কেউ জানে না। দুজনেই তাকিয়ে থাকে সেই হাসি মুখ সৌম্যের দিকে। তিনি বলতে থাকেন, জীবনের দরজাগুলো একে একে বন্ধ না হলে মানুষ তো আর এগোবেই না। সেই একই ঘরে ঢুকে বসে থাকবে।  জীবন স্থবির হয়ে যাবে। সেই জন্যই তো কিছু মানুষের জন্য দরজাগুলো বন্ধ হয়ে যায়, কারণ তাদের যে অনেক পথ চলতে হবে। তিনি একটা কাগজে খোপ আঁকতে থাকেন। তারপর বলেন, 'জানতো আমি সংস্কৃত টোলের অধ্যাপক ছিলাম। তার সাথে এই বিদ্যাও চর্চা করেছি। এবার বলো দেখি, তোমার রাশি, লগ্ন কি? এই কদিনে রূপার এসব মুখস্থ হয়ে গেছে। সে বলতে থাকে। তিনি আরও কি লিখতে থাকেন সেই খোপ গুলোতে। জিজ্ঞাসা করেন, আমরা কি জানতে চাই। মায়া বলে ওঠে, 'ওর সংসার'...........শেষ হয় না ওর কথা, উনি বলে চলেন, যে স্থানে শক্তির অসম্মান হয় সেই স্থানে শক্তি ছিন্নমস্তা হয়ে যান, কি বুঝলে?  ওর সাধনার কাল এটা। সংসার ওর জন্য নয়। ওরা তাকিয়ে থাকে সেই শান্তি মূর্তির দিকে। তিনি লিখে দিচ্ছেন রুপার ভবিষ্যৎ, তাঁর হাত কাঁপছে। সেই কাগজ হাতে নিয়ে সে বাড়ি ফেরে। মনের মধ্যে তার উথাল পাথাল। কোনটা সত্য? মা বাবার সামনে সে দুটো কাগজই মেলে ধরে। 'মা গো, এই দেখ, কোনটা সত্যি?' সে মাকে সব কথা খুলে বলে। মা, তার জন্মদাত্রী মা সব শুনে বলেন, 'বয়স্ক মানুষ, কি দেখতে কি দেখেছেন, কি লিখতে কি লিখেছেন, সব কথা কি ধরতে হয়?' রূপার আর উত্তর দিতে ইচ্ছা করছে না। সে অনুভব করতে পারে, তার সাধনা কাল শুরু হয়ে গেছে। এই কলঙ্ক তার আজীবনের সঙ্গী হয়ে থেকে যাবে। আর তার চোখের সামনে চিরকালীন সম্পর্কের, সারা জীবনের বিশ্বাসের দরজাটাও ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।

কবিতা ৮ ।

 সপ্তসিন্ধু পার করে লখিন্দর ফেরে ঘরে।সাথে করে  বিবিধ রতন। শঙ্খ বাজে, উলু দেয় এয়োতি, পুরজন। বাপ তার, চন্দ্র সওদাগর। লখার সাফল্যে মুখে তার  গো...