খুকি, দেখতো কে এলো? যাই মা, ঘরের
ভিতর থেকে রুপা সাড়া দেয়। ওমা, টোটোন দাদা এসেছে । মা বেরিয়ে আসেন, 'কতদিন
পরে এলি,
বাড়িতে সব ভালো তো?' হ্যাঁ, সবাই ভালো আছে। দুপুরে খেতে বসে পুরোনো দিনের কত কথা, কত গল্প, শেষই হতে চায় না। কি যেন একটা বলবি বলেছিলি, মা জিজ্ঞাসা করেন। ‘আমি জ্যোতিষবিদ্যা নিয়ে পড়াশুনা করছিলাম, পরীক্ষাও দিয়েছিলাম। জানো মামী, আমি ফার্ষ্টক্লাস পেয়েছি’।তাই
নাকি,
সে’ত খুব ভালো কথা। তা বোনের হাতখানা একবার দেখে দিস দেখি। পড়াশুনায়
মন নেই যেন।
কৈ, তোর হাতখানা
দেখি একবার। মনে একরাশ কৌতূহল নিয়ে সে হাতটা এগিয়ে দেয়। মায়ের কাছে রাশি লগ্ন
সব জানতে চায়। আর ও অবাক চোখে তাকিয়ে দেখে, দাদা তার কত কি জানে। রাতের আকাশের সব গ্রহ তারাদের কাজ
কর্ম সব জেনে ফেলেছে। কত শক্ত, কত মোটা সব বইগুলো, আগেরবার
পিসির বাড়িতে গিয়ে সে দেখেছিল। সম্বিৎ ফেরে মায়ের কথায়, 'কিরে
কিছু বলবি না',
টোটোন দাদা গম্ভীর মুখ করে বলে, জীবনে অনেক কষ্ট ওর, গ্রহযোগে সংসারও হবার নয়, তার মধ্যে আবার..'.....'কিরে থামলি কেন' ,' না মানে কি বলবো ভাবছি, হাতে একটা স্পষ্ট হারেম যোগ দেখতে পাচ্ছি।' মা একদম চুপ করে বসে থাকে। এত কথার মধ্যে ও জীবনের কষ্টের
কথাটা বুঝলো। বাকি কথাগুলো বুঝতে পারেনি। দশ এগারো বছর বয়সে কতটাই বা বোঝা যায়? সন্ধ্যাবেলায় দাদা বাড়ি চলে গেল। সাথে করে বাড়ির খুশিভাবটাও
যেন নিয়ে গেল।
বাড়িটা আশ্চর্য ভাবে বদলে যেতে লাগলো। খেলাধুলো বন্ধ হয়ে
গেল তার। সে হঠাৎ বড় হয়ে গেছে। সব সময় শাসন। এটা করবে না, ওর সাথে মিশবে না।
কিছুই বুঝে উঠতে পারে না সে। মাস্টারমশায়ের কাছে পড়তে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল।
একজন দিদিমণি ঠিক করা হয়েছে, বাড়িতে এসে পড়াবে। বার্ষিক পরীক্ষা শেষে টোটোন দাদাদের বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিল
সবাই মিলে। টোটোন রূপার পিসতুতো দাদা। পিসি আর মা কি যেন কথা আলোচনা করে। ওকে দেখে
চুপ করে যায়। কি এক অজানা কারণে স্বাভাবিক আচরণের তাল কেটে যাচ্ছে বারবার। না, এবারে যেন আগের বারের মতো আনন্দটাই হলো না। বয়স বাড়তে থাকে
তার। কি যেন এক কারণে সব আত্মীয় স্বজনের সাথেই দূরত্ব বাড়তে থাকে। দাদা দিদির
ফিসফাস করে। হাসাহাসি করে মুখ টিপে।
সবে মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে। ও মনে মনে ঠিক করে রেখেছে, এই ছুটিতে মামার বাড়ি, পিসীদের বাড়ি, জেঠুর বাড়ি সব জায়গায় যাবে। কিন্তু বাস্তবে কোথাও যাওয়া হয়ে ওঠে না। মা ওকে
কোথাও যেতে দিলো না। নিজের বোনের সাথেও একটা দূরত্ব যে তৈরি হয়েছে, সেটা বেশ বুঝতে পারে।
রেজাল্ট বেরোলে এগারো ক্লাসে ভর্তি হয়। ক্লাসের মেয়েদের
সাথেও মন খুলে মিশতে পারে না। অনেকদিনের অভিজ্ঞতায় সে বুঝতে পেরেছে যে সবাই ওকে এড়িয়ে চলতে চায়। বাড়িতেও সমবয়সী
ভাইবোনদের সাথে দূরত্ব যেন সীমাহীন। মায়ের চোখ মুখেও সবসময় একটা চাপা ভয়, কোথাও যেন একটা অবিশ্বাসও কাজ করছে। বার ক্লাসে পড়ার সময়
একটা বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে আসে কে যেন। পাত্রপক্ষ কোষ্ঠি বিচারের কথা বলে। মা বেঁকে
বসেন। মা গজগজ করেন, আজকালকার যুগেও এত কুসংস্কার, সাফ বলে দেন, কোষ্ঠি নেই। কিন্তু রূপা তো জানে যে কোষ্ঠি আছে। একদিন
আলমারি থেকে সেই কোষ্ঠি সে বার করে আনে। মা দেখতে
পেয়ে ছুটে আসেন। চুলের মুঠি ধরে
বলেন,
' পোড়ারমুখী, নিজের হাতে নিজের পায়ে কুড়ুল মারছ?' ততক্ষণে
রুপার কাগজখানা পড়া হয়ে গেছে। লেখাগুলোর মানে আজ সে বোঝে। মাকে বলে, 'কেন এত ভাবছো মা, তুমি তো এসব মান না।' মা বলেন, গ্রহ নক্ষত্রের বিচার ভুল হয় না রে।'
দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের আনা সেই পাত্রের সাথে বিবাহ সম্পন্ন
হয়ে যায়। বাবা মায়ের মাথা থেকে যেন পাথর নেমে যায়। নিকট আত্মীয়দের ভালোবাসায়
সেই ভীষণ গোপন কথা তার শ্বশুরবাড়িতেও
পৌঁছলো। তারপর শুরু হলো তার বাবা মায়ের নিন্দে। তারা নাকি সব জেনেও তাদের সর্বনাশ
করেছে। চুপ করে থাকে সে, কিই
বা উত্তর দেবে? কে বলে
বোবার শত্রু নেই? একবার ভাবে বাবা মায়ের কাছে চলে যাবে, পরক্ষণেই বাস্তবে ফেরে। ওখানে ফিরলেও এই সমস্যার সুরাহা হবে
না। মনে ভাবে, না, কোনো প্রতিবাদ সে করবে না।....কিন্তু একদিন আর পারলো না সে, তাকে যেদিন দুশ্চরিত্রা বলা হলো, সেই দিন সে আর পারলো না। সেই দিন ভীষণ অপমানে সে তার
একমাত্র ভরসার জায়গা, বাবার বাড়িতে ফিরে এলো। সবকথা শুনে মা আবার টোটোন দাদাকে ডেকে পাঠালো, যদি প্রায়শ্চিত্ত করে দোষ কাটানো যায়। দাদাকে সামনে পেয়ে মা
একেবারে ভেঙে পড়েন, কি হবে এবার? মাকে সান্তনা দিয়ে সে বলে, যা হবার তা হয়েছে, ওকে শ্বশুরবাড়িতে পাঠাবার ব্যবস্থা করো। নাহলে.......নাহলে
কি......
এতক্ষণ সব শুনছিলো সে দাঁড়িয়ে, এবার রূপা কথা বলে, 'না আমি
আর ওই বাড়িতে ফিরবো না’।
'ফিরতে তোমায় হবেই,' মা চিৎকার করে ওঠে।
রূপা শান্ত স্বরে বলে, 'মা,তোমরা
সেই ছোটবেলা থেকে আমাকে এইরকম একটা ভুলের জালে বেঁধে ফেলেছো কেন? আমার সেই না বোঝার বয়স থেকে এই কথা গুলো চর্চা করে করে
প্রায় সত্যতে রূপান্তরিত করেছ। আর এর ফলে যে একটা জীবন শেষ হয়ে গেল সেটা তোমাদের
চোখ এড়িয়ে গেল কি করে? বিয়ের সময় তুমি কোষ্ঠি দেখাতে চাও নি, কুসংস্কার বলেছিলে অথচ ওই কাগজটাকে তুমি যে বিশ্বাসে জড়িয়ে
ছিলে তাকে কি বলে, মা?
কাগজটার বদলে যদি নিজের মেয়েকে বিশ্বাস করতে তাহলে আমার
জীবনটা তো নরক হয়ে যেত না। আমায় তুমিই বিশ্বাস করতে পারো নি, বাইরের লোক কিভাবে বিশ্বাস করবে?' তারপর দাদাকে দেখিয়ে বলে, 'ওর যদি
এতই জ্ঞান তাহলে ও নিজের ভাগ্য দেখতে পায় না কেন? ওর চাকরি হয় নি কেন, কেন লোকের মনে অন্ধবিশ্বাসের বীজ বুনে ওকে সেই ফসলে নিজের
দিন গুজরান করতে হয়? বলো মা, বলো।' মা মাথা নিচু করে বসে থাকেন। দাদা ওকে বোঝাতে আসে। কিন্তু না,আজ সে আর কারুর কথা শুনবে না। অনেক সহ্য করেছে সে। আজ এর
প্রতিবাদ তাকে করতেই হবে। নাহলে তাকে আরো কোণঠাসা হয়ে পড়তে হবে। খবরের কাগজে
প্রায়ই দেখা যায় আদিবাসী সমাজে একটি মেয়েকে ডাইনি চিহ্নিত করে বিভিন্ন অত্যাচারের
ঘটনা,
এমন কি তাকে হত্যা করতেও তারা পিছপা হয় না। প্রথমে তাকে সমাজ ও পরিবার থেকে সুকৌশলে বিচ্ছিন্ন
করে দেওয়া হয়, তারপর
মেয়েটি একদম একা........যেমন খুশি অত্যাচার করো। সেও তো এখন একদম একা। আর তার এই
পরিস্থিতির জন্য তো কোনো অশিক্ষিত আদিবাসী সমাজ দায়ী নয়।
ছোটবেলা থেকে সে একাই ছিল। আর আজ তো আরও বেশি একা। চাকরিও
করে না। বাড়ির বাইরের জগৎ তার একেবারেই অপরিচিত। বাড়ির একটা ঘরে সে একাই থাকে। সেই
কোষ্ঠিটা রোজ একবার করে পড়ে। খুব আশ্চর্য লাগে তার, এই সাধারণ একটা কাগজ তাকে তার বাবা, মা সবার থেকে আলাদা করে দিয়েছে। জ্যোতিষশাস্ত্র কি এতোই
নির্ভুল? নিজের সন্তানের থেকেও তার প্রতি বিশ্বাস বেশি হতে পারে?
একদিন তার এক বান্ধবী দেখা করতে এসে। রূপা তাকে সব কথাই
খুলে বলে, খালি কোষ্ঠীর কথাটা বলে উঠতে পারে না। ওর বন্ধু, মায়া, ওকে বলে, ওদের
এক পারিবারিক শুভানুধ্যায়ী আছেন, যিনি হাত দেখতে পারেন। রুপার মাথায় একটা বিদ্যুৎ খেলে যায়। সে যেতে
রাজি হয়ে যায়। ওরা নির্দিষ্ট দিনে সেই ভদ্রলোকের বাড়ি গিয়ে পৌঁছয়। তিনি নিজেই এসে
দরজা খুলে দেন। সাদা ধুতি, সাদা
ফতুয়ায় এক শান্ত, সৌম্য
অতি বৃদ্ধ মানুষ। পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে দুজনে। মায়াই কথা শুরু করে। তিনি একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন রূপার দিকে, যেন কি একটা পড়ছেন। একমুখ হাসি নিয়ে বলে ওঠেন, যে দরজাটা বন্ধ হয়ে গেছে সেটা আর খোলার দরকার কি? জীবনের দরজার কি অভাব? কখন কোন দরজা কার সামনে খুলে যাবে কেউ জানে না। দুজনেই
তাকিয়ে থাকে সেই হাসি মুখ সৌম্যের দিকে। তিনি বলতে থাকেন, জীবনের দরজাগুলো একে একে বন্ধ না হলে মানুষ তো আর এগোবেই
না। সেই একই ঘরে ঢুকে বসে থাকবে। জীবন
স্থবির হয়ে যাবে। সেই জন্যই তো কিছু মানুষের জন্য দরজাগুলো বন্ধ হয়ে যায়, কারণ তাদের যে অনেক পথ চলতে হবে। তিনি একটা কাগজে খোপ
আঁকতে থাকেন। তারপর বলেন, 'জানতো আমি সংস্কৃত টোলের অধ্যাপক ছিলাম। তার সাথে এই
বিদ্যাও চর্চা করেছি। এবার বলো দেখি, তোমার রাশি, লগ্ন কি? এই কদিনে রূপার এসব মুখস্থ হয়ে গেছে। সে বলতে থাকে। তিনি
আরও কি লিখতে থাকেন সেই খোপ গুলোতে। জিজ্ঞাসা করেন, আমরা কি জানতে চাই। মায়া বলে ওঠে, 'ওর
সংসার'...........শেষ হয় না ওর কথা, উনি বলে চলেন, যে স্থানে শক্তির অসম্মান হয় সেই স্থানে শক্তি ছিন্নমস্তা
হয়ে যান, কি বুঝলে?
ওর সাধনার কাল এটা।
সংসার ওর জন্য নয়। ওরা তাকিয়ে থাকে সেই শান্তি মূর্তির দিকে। তিনি লিখে দিচ্ছেন
রুপার ভবিষ্যৎ, তাঁর
হাত কাঁপছে। সেই কাগজ হাতে নিয়ে সে বাড়ি ফেরে। মনের মধ্যে তার উথাল পাথাল। কোনটা
সত্য?
মা বাবার সামনে সে দুটো কাগজই মেলে ধরে। 'মা গো, এই দেখ, কোনটা
সত্যি?'
সে মাকে সব কথা খুলে বলে। মা, তার জন্মদাত্রী মা সব শুনে বলেন, 'বয়স্ক
মানুষ, কি দেখতে কি দেখেছেন, কি লিখতে কি লিখেছেন, সব কথা কি ধরতে হয়?' রূপার আর উত্তর দিতে ইচ্ছা করছে না। সে অনুভব করতে পারে, তার সাধনা কাল শুরু হয়ে গেছে। এই কলঙ্ক তার আজীবনের সঙ্গী
হয়ে থেকে যাবে। আর তার চোখের সামনে চিরকালীন সম্পর্কের, সারা জীবনের বিশ্বাসের দরজাটাও ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।