মুন্সিয়ারী এসে পৌঁছেছি। গন্তব্য পঞ্চচুল্লি
বেসক্যাম্প। এর আগেও বেশ কয়েকবার এসেছি মুন্সিয়ারী। পঞ্চচুল্লি শিখররাজির
সৌন্দর্যে মোহিত হয়েছি বারবার। সূর্যাস্তকালে পঞ্চচুল্লি অপার্থিবরূপ ধারণ করে।
কতবার ভেবেছি যাব পঞ্চচুল্লি বেসক্যাম্প। এবার সেই স্বপ্ন সার্থক হতে চলেছে।
পথ চলার রসদ কেনাকাটা সহ সব প্রস্তুতি সম্পূর্ণ। রাতে খাওয়ার পরে আবার একবার মুঠোফোনে অন্তর্জালে আড়ি
পাতলাম। বেসক্যাম্প থেকে পঞ্চচুল্লি। একই ছবি বারবার দেখা পুরোনো অভ্যাস।
পঞ্চচুল্লি ছাড়া আর কি কি দেখা যাবে? রাজরম্ভা, হংসলিঙ্গ চূড়া দুটি দেখা যায় ।
পঞ্চ চুল্লি ১, ২, ৩, ৪, ৫, তারপর রাজরম্ভা। একী , পঞ্চচুল্লির চারটে চূড়া দেখা যাচ্ছে! আর একটা কই ? বেসক্যাম্পের ছবিটা বারবার দেখছি, কিন্তু
একটা চূড়া তন্নতন্ন করেও দেখতে পেলাম না। অথচ, মুন্সিয়ারীর
হোটেল থেকে জানালার বাইরে পাঁচটি শিখরই ঝকমক করছে। গাইড কে ফোন করলাম। কেউ কিছুই
বলতে পারছে না, কি ঝামেলায় পড়া গেল! এখন কি করি,
এই চিন্তায় ঘুম পালাল। অনেক কষ্টে নিজেকেই আয় ঘুম, আয় ঘুম বলে ঘুম পাড়ালাম।
সকালে উঠে আবার সেই পাঁচটি শৃঙ্গ। আশ্চর্য ব্যাপার
বেসক্যাম্প থেকে একটি হাওয়া! যাই হোক, ধারচুলায় পৌঁছলাম। SDM অফিস থেকে অনুমতি পত্র যোগাড় করে ছোট একটা গাড়ি ধরে
গাড়িপথে দার গ্রাম। এই পথের গাড়িপথ এই গ্রাম পর্যন্তই। হাঁটা শুরু, মাথার মধ্যে পঞ্চচুল্লির হারিয়ে
যাওয়া চুড়াটা। হাঁটছি হাঁটছি; ধীর ধীরে। বাঁ পায়ের গোড়ালিটা
ব্যথা করেছে। ভুলেই গেছিলাম দিন দুয়েক আগে বাঁ-পাতা মোচকে ছিল। ফুলে গিয়েছিল,
তার সাথে ঝনঝনিয়ে ব্যথা। চিন্তা ছিলই কি করে হাঁটব। এবার ছেলে ছিল
সাথে। ওর টেন বোর্ডের পরীক্ষা শেষ হয়েছে সবে। সকাল বিকাল ব্যথা কমানোর ওষুধ খেয়ে ব্যথাটা অত মালুম হচ্ছিল না। কিন্ত পাহাড়ী
পথে আবার ব্যথাটা জানান দিচ্ছে। পৌঁছলাম সোবলা। আর্মি ক্যাম্প, নদীর ধারে। বিকেলবেলা ফৌজী চা খেলাম।
যে অফিসার ছিলেন, ভাল মানুষ। আমাকে অল্প খোঁড়াতে দেখে
জিজ্ঞেস করলেন। জানা গেল তিনি ডাক্তারও বটে। তিনি ব্যথা কমানোর জন্য ফৌজী ওষুধ
দিলেন। আমার আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেল। রাতে ফৌজী খানায় আপ্যায়ন করেলেন। পঞ্চচুল্লির কথা জিজ্ঞেস করলাম।
দূঃখের সাথে জানালেন ওটা সম্পর্কে তিনি কিছুই জানেন না। আসলে
ওটা ওনার সরকারী কর্মের আওতার মধ্যে পড়ে না কিনা, তাই। আমি শুনে খুব একটা খুশি হলাম না, কিন্তু
শুভরাত্রি জানিয়ে শুতে গেলাম।
আজ যাব নাগলিং হয়ে বালিঙ। নাগলিং থেকে বালিঙ এর
রাস্তায় চড়াই উতরাই কম, সোজা
রাস্তা। হাঁটছি, ছবি তুলছি, ভালই লাগছে,
কিন্তু মনের ভিতর খচখচ সেই পঞ্চচুল্লি। নদীর ধারে নামছি, কখনও রাস্তা ধসে গেছে বলে, কখনও বা জঙ্গল পেরচ্ছি।
সারাদিন মেঘ রোদের লুকোচুরি। বালিঙ পৌঁছতে প্রায় তিনটে বাজল। আবার মিলিটারী চৌকিতে
যেতে হলো। এক কপি পরিচয়পত্র জমা করতে হলো। অফিসার-ইন-চার্জ হাসতে হাসতে বললেন
এখানে সবাই পরিবার নিয়ে আসে ট্রেক করতে, মাঝে মাঝে
বাবা-ছেলেও আসে, কিন্তু মা-ছেলে? না
ম্যাডাম, এই প্রথম দেখলাম। আমিও হাসলাম। তারপর, সেই মধ্যেকার পোকাটা ওনার সামনে মেলে ধরলাম। পঞ্চচুল্লি বেসক্যাম্প গেছেন?
হ্যাঁ, আমাদের জওয়ানরা ওদিকে যায়। বেসক্যাম্প
ছাড়িয়েও আমাদের আর্মি ক্যাম্প আছে। কিন্তু, মজার কথা কি
জানেন ম্যাডাম, ওখান থেকে ৪টে চূড়া দেখা যায়, ১ টা দেখা যায় না। এই তো হতে চাঁদ পেয়েছি! তাহলে ওটা কোথা থেকে দেখা যায়?
হা হা , যাবেন? পারবেন?
‘বলুন না’, আমি বলি, ‘এখান
থেকেই যেতে হবে?’ চাফা হিমবাহ, আসল নাম
উত্তর বালাতি হিমবাহ। আমি অভিভূত হয়ে যাই। কিন্তু, আবার
অনুমতি পত্রয়েল ঝামেলা। উনি বললেন, আগে বেসক্যাম্প ঘুরে
আসুন। তারপর দেখছি।
এর পরের কাঠগুলো সংক্ষেপে বলি। আমি পঞ্চচুল্লি
বেসক্যাম্প গেলাম ওর ফিরে এলাম। আবার সে অফিসারকে খুঁজে বার করলাম এবং অনুমতি
পত্রের জন্য দুই হাত পাতলাম। “কেউ যায় না, ম্যাডাম, এত সুন্দর বেসক্যাম্প ঘুরে
এলেন, বাড়তি কিছু নেই। কোন লোকজন জনবসতিও নেই।”
আমাকে একটু অনুমতি দিন না, আমি দেখতে চাই। “সঙ্গে ছেলে, দেখে মনে হচ্ছে, নাবালক। আমরা এতটা রিস্ক নিতে পরি
না” আমিও নাছোড়। ঠিক আছে, যতটা পারব যাব, তারপর ফিরে আসব। আমার বেসক্যাম্প পথের গাইড ছিল উত্তরাখণ্ডের ছেলে। শেষমেষ
ওকেই শিখণ্ডি খাড়া করি। ওর সব কথা শুনবো, ও যেখান থেকে ফিরে
আসতে বলবে, ফিরে আসব।
হা হা হা হা –বড়ী জিদ্দি হ্যায় আপ তো...সামহালকে
জাইয়েগা। আকে হামসে মিলিয়েগা। লেকিন ইয়াদ রহে খতরা নেহি উঠানা হ্যায়, ব্যস।
আজ ঘুম থেকে উঠেই তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিলাম। ক্যাম্পের
পাশ দিয়ে আসার সময় দেখা হলো ভদ্রলোকের সাথে, wish করলেন। প্রথমে খানিক চড়াই ভেঙে উঠলাম জঙ্গলের ভিতর দিয়ে। পথ বলতে ঐ। ব্যস, রাস্তা বন্ধ। সামনে একটা বিশাল পাথরের চাট্টান । হয়ে ভগবান,
এবার কি করি? এখান থেকেই ফিরতে হবে নাকি?
কিছুতেই নয়। মনে মনে স্থির করি, যেতেই হবে,
যাবই। তারপর, হিমালয়কে প্রণাম করে, লোপাকে সাবধান করে, সেই পাথরের ওপর পা রাখলাম। তারপর,
এক পা, এক পা করে টিকটিকির মতো পাথরটাকে
কোনাকুনি ভাবে পর করলাম। ওপরের পথও জঙ্গল, পথ নেই। ভুল বললাম,
জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হাঁটা। শুধুই চড়াই। অনেক চলে, একটা সবুজ বুগিয়ালে এসে, পৌঁছাই। সেই চড়াই পথ
বুগিয়ালের ভিতর দিয়ে চলে গেছে। সবুজে সবুজ চারপাশ, তার মধ্যে
প্রিমুলার গালিচা।
দেখা যাচ্ছে সামনের পর্বতমালা। বাঁ দিকে নাগলিং রেন্জ, একদম ডান দিকে পঞ্চচুল্লির হারিয়ে
যাওয়া চূড়া। চলতে চলতে প্রিমুলার গালিচা পেরিয়ে উঠে এলাম আরও উঁচুতে। এগিয়ে চলেছি
তাকে আরও কাছ থেকে দেখবো বলে। এক স্বর্গীয় উপত্যকা। ঝোপঝাড় আলো করে ফুলে আছে।
হালকা বেগুনি রডোডেনড্রন। পিছনে নাগলিং রেন্জ। ডানদিক থেকে নেমে এসেছে ছোট ছোট
হিমবাহ। নদীর ধারা জমে বরফ। সেই সবুজের মাঝে সাদা হিমবাহের আলপনা, নীল আকাশে সাদা মেঘের ওড়াউড়ি । এক স্বপ্নের জগতে। দূরে ইয়াক চরছে। ক্রমে, জমে যাওয়া হিমবাহ অঞ্চলে প্রবেশ করলাম।
তারপর, দূর থেকে যাকে দেখে আশ মেটে নি, যার
অপেক্ষায় এত পথ পেরলাম, তার সাথে দেখা হলো। সেই বেসক্যাম্প
থেকে হারিয়ে যাওয়া পঞ্চচুল্লির একচূড়া। স্বমাহিমায় দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু, আমরা এত কাছে চলে এসেছি যে, না কাছে এসেছি বলার থেকে
কোলে উঠেছি বললে ঠিক বলা হবে। কারণ, যে হিমবাহটার উপর দাঁড়িয়ে আছি সেটা ঐ চুড়ার উপর থেকে সটান নীচে
নেমে এসেছে। যার ফলে মাথা উঁচু করেও আর ভাল দেখা যাচ্ছে না। অনেকক্ষণ পর আমাদের
কোল থেকে আবার নামিয়ে দিলেন। অপূর্ব এক অভিজ্ঞতা!
ফিরতি পথে অভ্যাসবসে পিছন ফিরলাম। হাসিমুখে বিদায়
দিলেন। প্রণাম জানলাম। শেষ মোড়টায় এসে আবার পিছন ফিরি। এক ঠান্ডা হাওয়ার ঝলক, ফিস ফিস করে বলে, ‘আবার এসো’।
ফেলে আসা পথের স্মৃতিকে কত অনায়াসে আর মনোমুগ্ধকর ভাবে তুলে এনেছ।
উত্তরমুছুন