বুধবার, ২৯ জুলাই, ২০২০

নদীর উজানপথে !

বিজ্ঞান বলেএই পৃথিবীতে সবই নাকি আছেশুধু খুঁজে নিতে হবে। বেশ কথা। কিন্তু কি খুঁজবোকবি বলেছেনখ্যাপা পরশ পাথর খোঁজেঅর্ধেক জীবন ব্যয় হয়ে যায় তারকোনো এক সময় পেয়েও শুধুমাত্র না চিনতে পারার জন্য আবার হারিয়ে যায়। জীবন সায়াহ্নে এসে সে উপলব্ধি করে যে আবার তাকে পুরোনো পথেই ফিরে যেতে হবেকারণ ওই পথেই সে অসাবধানে সেই অমূল্য রতনটি ফেলে এসেছে। ঠিক এই খানেই সেই অমোঘ প্রশ্নটি মনে জাগেসময় পাওয়া যাবে কিকে জানে.......

আসলে আমরা সবাই সর্বক্ষণই কিছু না কিছু খুঁজে চলেছি। তাই নাআমিও তার ব্যতিক্রম নই। আমিও খুঁজে চলেছি। শহুরে জীবনের বিস্তর খোঁজাখুঁজির মাঝে জীবনটাই হারিয়ে গেছে। এখন বেঁচে আছির বদলে টিকে আছি বললেই বোধহয় সত্যটুকু সুবিচার পায়

বেশিদিন বাড়িতে থাকতে পারি না। দমবন্ধ লাগে। সময় সুযোগ বুঝে হরিদ্বার যাওয়ার টিকিট কাটি।.....ভোরেরবেলায় ট্রেন থেকে নেমে হোটেলে যাই। তারপর স্নান সেরে সোজা হর কি পৌড়ি ঘাটে।...দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখি কত মানুষভোর থেকেই পুণ্যার্থীসাধুভবঘুরে সবাই একঠাই। কেউ শীতল হয়কেউ পুন্য মাপে। আর কত যে ভিখিরিকেউ গেরুয়া বসনেকেউ ছিন্নবস্ত্রে। এই ভারতবর্ষে যুগে যুগে গঙ্গার ধার বরাবর এই ভিক্ষাকর্মীদের এক চলমান জীবনযাত্রা। সে বিশ্বনাথের কাশীই হোক অথবা এই হরিহরের দুয়ারএর কোনো পরিবর্তন নেই। রোদ বাড়েআমি ফেরার পথে ধরি সন্ধ্যার আগে আবার আসি। একটু পরেই আরতি শুরু হবে। ধীরে ধীরে আরতি দর্শনার্থীদের ভিড় বাড়ে। আরতি শেষে যে যার ঘরে ফিরে যায়। শেষ সন্ধ্যায় ঘাটেরও ক্লান্তি আসে। পাহাড়ের হাওয়ায়গঙ্গার কুলু কুলু ঘুমপাড়ানি গানে ঘাটও একসময় ঘুমিয়ে পড়ে। বসে আছি ঘাটের কিনারায়নদীর জল ছুঁয়েএই সময় অনেক পুরোনো কথা মনে আসে। জলে ফাঁড়া ছিল বলে ছোট বেলায় জলের কাছে যাওয়া বারণ ছিল। আজ নদীর জল ছুঁয়ে বসে আছি। কেউ আর নিষেধ করার নেইসবাই আজ আকাশের তারা হয়ে গেছে। হয়তো সেখান থেকেও বারণ করছেকে জানে। আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি। চাঁদের হালকা আলো নদীর শরীরে ছায়া জড়ায়সেই অন্ধকারেনদী পাশ ফিরে শোয় ওপারের দোকানগুলোর আলো সব নিভতে শুরু করেছেএবার ফিরতে হবে। নদীকে বলিকাল আবার আসবোকেমনএই আমার এক রোগসবার সাথেই কথা বলি। পিছন থেকে কে যেন টেনে ধরেএকবার আমার উজানে যাবেআমার ছোট বেলার খেলাঘর। পিছন ফিরিকই কেউ না তোশুধুই কুলু কুলু কুলু কুলু......... মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায়উঠে পড়ি। প্রথম বাসটাই ধরবো ।.....

বাসে উঠে একটা জানলার ধারে জায়গা পেলাম। বাস চলতে শুরু করতেই না ডাকতেই ঢুলুনি এলোজলদি উতরোঘুম ভেঙে যায়ব্যাসী পৌঁছেছি। আলুর পরোটা আচার দিয়ে খেয়ে আবার নিজের জানলার ধারে। জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি। স্কুলের পোশাক পরা ছোট ছেলেরা স্কুলে যাচ্ছেকোথাও বা রাস্তা তৈরি হচ্ছে। কোথাও  পাহাড় থেকে নেমে আসা ধারায় দৈনন্দিন কাজ সারছে গ্রাম র মানুষ। হিমালয়ে সাধুবাবারা হেঁটেই চার ধাম দর্শন করেনতাঁরাও হেঁটে চলেছেনহাতে কমন্ডলুপিঠে এক ঝোলা। মাঝে মাঝে বাস দাঁড়াচ্ছেদুচার জন নামছেকেউ বা উঠছে। এই হলো হিমালয়ের পথে যাত্রার চলমান ছবি

এসে গেলাম দেবপ্রয়াগ। ভাগীরথী আর অলকানন্দার বিবাহ স্থল। ওপর থেকেই দুজনার হাতে হাত রেখে চিরজীবন সাথে চলার অঙ্গীকারের চিরপরিচিত ছবিটি বেশ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। হঠাৎ মনে পড়ে হরিদ্বারের ঘাটে র কথা। গঙ্গা তো এক ধারা নয়তিন ধারা মিলিত হয়েছে। এখন কি করিঅবশেষে ঠিক করলাম অলকানন্দার উজানেই যাবো। রুদ্রপ্রয়াগে আজকের যাত্রাপথের বিরতি

আজ জসীমঠ যাবো। গাড়োয়ালের সব শহর গুলোতেই অতিরিক্ত জনসংখ্যা বৃদ্ধির কুফল ফলতে শুরু করেছে। এ পথের দূরত্বও অনেক। সারাদিন ধরে চলে নন্দপ্রয়াগকর্ণপ্রয়াগ সব পার করে  চলেছি। চায়ের বিরতি। গাড়ি থেকে নাম হলো  উল্টো দিকে তাকিয়ে দেখি এক বড় পাহাড়ি নালাতাকে নালা না বলে নদী বলাই ভালোডানদিকের এক উপত্যকা থেকে নেমে এসেছে। কি নাম ভাইতোমারতার উচ্ছলতা অবাক করে আমায়। আমার নাম বিরহী গোবিরহী। আমি একটু ঠাট্টা করে বলিকিসের বিরহ তোমারআর বিরহে বুঝি কেউ নাচেসে নুড়ির নুপুর বাজিয়ে এক  পাক নেচে নিলো। এক দমকা হাওয়ায় গাছ থেকে কত পাতা যেন ঝরে পড়লো। আমার  দিকে তাকিয়ে বললকোন দেশ থেকে এসেছ তুমিবিরহই তো নাচের উৎস। না হলে শুধু শুধু কেউ নাচেআমাদের দেবাদিদেব মহাদেবতাঁর স্ত্রী সতীর বিরহে কত কেঁদেছেনতারপর সেই প্রিয়দেহ বুকে নিয়ে যে ছন্দে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করেছিলেনসেটাই তো নাচ। সেই নাচের তালে পৃথিবী কেঁপে উঠেছিলদেবতারাও জেগে উঠেছিলেন। আহাকতদিন আর অমন নাচ দেখিনাবলতে বলতে সে উদাস হয়ে গেল। কতক্ষন সে চুপ করে রইলোতারপর যেন আপনমনে বলতে লাগলোতাঁর তো সেই শোকের আর বিরাম হলো না। তিনি তো এখনো কেঁদেই চলেছেন। সে অশ্রু ধারাই তো আমার উৎস। তাই তো আমার নাম বিরহী। সেই দুঃখ ধারা আমি যুগে যুগে বয়ে নিয়ে যায় সাগরেতা নাহলে এই হিমালয় পর্বত কবেই তলিয়ে যেত। আমি হাঁ করে শুনছিহঠাৎ সম্বিৎ ফেরে তারবলেদেখলে তো কত দেরি করিয়ে দিলে আমায় সরো দেখিপথ ছাড়োবলতে বলতেই ছুট দিলো। সেই বিরহের ছন্দ আমার প্রাণের গভীরেও কি এক ব্যথার মূর্ছনা জাগায়। আবার গাড়ি চলে। অবশেষে জসীমঠ পৌঁছলাম। প্রায় চারটে বাজে। আজ এখানেই থাকবো। কাল প্রথম গেট ধরে বদ্রিনাথ যাবো। রাতের আলো ঝলমলে জসীমঠ ভারী সুন্দর। অনেক নীচে অলকানন্দার স্রোতকে ব্যবহার করে বিদ্যুৎ তৈরি হচ্ছে। সেই কর্মকান্ডের আলোয় সারা পাহাড় আলোকিত। চাপা এক কান্নার আওয়াজকে যেন গুমরে গুমরে কাঁদছে?

ভোরে উঠে মন্দিরে প্রনাম করে বদ্রীনাথ মার্গে দাঁড়িয়ে আছি। আজকের গন্তব্য বদ্রীনাথ হয়ে মানাগ্রাম । এই গ্রামটি এই পথের শেষ জনপদ। এর পর আর কোনো জনবসতি নেই। এই জসীমঠ থেকে বদ্রীনাথ পঞ্চাশ কিলোমিটার রাস্তা। দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম। কি ভিড়ভক্তদের। ভক্তছাড়া ভগবান অচল। একটু এগিয়ে ঝোলাপুল পার করলেই স্বয়ং বদ্রীবিশালের দরবার। নীচ দিয়ে বয়ে যায় অলকানন্দার ধারা। এককাপ চা খেয়ে মানাগ্রামের গাড়ি ধরি। গ্রামে পৌঁছে স্থানীয় পঞ্চায়েতের সাথে কথা বলে তাঁবু লাগাই। সব ব্যবস্থা করে পায়ে পায়ে ভীম পুল পার করে  এগোই। এই পথ সোজা চলে গেছে বসুধারা প্রপাতের পায়ের কাছে। সরস্বতী মন্দিরের পাশ থেকে সগর্জনে বেরিয়ে আসছেন মা সরস্বতী। প্রবল শব্দে কান পাতা দায়  কোথায় সেই শ্রীপঞ্চমীর শান্তশিষ্ট  রূপের  ঠাকরুনটিএকী ভয়ঙ্কর রূপ তারবুকের ভিতর কেঁপে ওঠে। এত শব্দে পাশের লোকের কথাই শোনা যায় নাতো আমার বিড়বিড় করে চাওয়া তিনি শুনবেন কি করেমরিয়া হয়ে প্রানপনে চিৎকার করে বলিবিদ্যা দাও। কি যে আশীর্বাদবানী উচ্চারিত হলো বলতে পারি না। বাঁদিকে অনেক নীচে গিয়ে সেই ধারা অলকানন্দায় মিশে যাচ্ছে। সেই মিলনস্থল কেশবপ্রয়াগ নামে পরিচিত। দেখতে দেখতে উপত্যকায় সন্ধ্যা নামে  আর কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রকৃতির আঙিনা তারার আলোয়  আলোকিত হয়ে উঠবে। বদ্রীনাথের শয়ন আরতিও হয়তো শুরু হয়েছে। কেশবপ্রয়াগের পুলের অপর পারে হালকা এক পথের নিশানাআগামীকাল ওই পথ ধরেই আমি যাব। ওই অস্থায়ী কাঠের পুলটিই এপারের সাথে ওপারের একমাত্র যোগাযোগকারী সূত্র। ফী বর্ষায় অলকানন্দা ওকে ভাসিয়ে নেয়ওর চোখেও তখন অলকানন্দার মতই সাগর মিলনের স্বপ্নকিন্তু কোনোদিনই সে সাগরে পৌঁছয় না। নদীর কোন বাঁকে যেন আটকে পড়ে। পাহাড় বড়ো মায়ায় তাকে পিছনে টেনে রাখে। নিকষ অন্ধকার নেমে আসছেপাহাড়ের উপত্যকায়। সেই অন্ধকারে কে কাঁদেখুব চাপা অথচ খুব স্পষ্টসে গুমরানো কান্না। সেই কান্না যেন পাহাড়ের অন্দরে ঘুরে ঘুরে মুক্তির পথ খুঁজে বেড়ায়। সরস্বতীর উদ্দাম গর্জনের সাথে মিশে সে গুমরানো কান্নার আওয়াজ সেই অন্ধকার রাতে কি এক আসন্ন মহাবিপদের সূচনা চিহ্নিত করে চলেছে

সকাল হয়। চারপাশে ছোট পাখির কলতান। উঁচু উঁচু সাদা মাথার বৃদ্ধ পাহাড়ের সারিহাসিমুখে স্বাগত জানায়কুশল জিজ্ঞাসা করে। তাঁদের প্রনাম জানাই। সূর্যের আলো তাঁদের আশীর্বাদ বয়ে আনেসেই  স্পর্শ আমায় পুন্যাঙ্গ করেশিহরণ জাগায়। আসলে হিমালয় দেবভূমি। সমগ্র হিমালয় অঞ্চলই সেই প্রাচীন কাল থেকে আজ পর্যন্ত পুণ্যব্রত  মহান ঋষিদের তপস্যা ভূমি। সেই তপস্যার পূতফল সেখানকার আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে আছে। আমায় যেতে হবে সত্যের পথ ধরে সেই পুন্য সলিলার আঁতুড় ঘরেযেখানে যেতে গেলে শরীরের সাথে সাথে মনের  শুদ্ধতার আবশ্যিকতাও বাধ্যতামূলক। সব গোছগাছ করে বেরিয়ে পড়লাম। অনেকটা পথ আজ হাঁটতে হবে তাই আমার পথ প্রদর্শক সংগ্রাম সিংকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। সোজা উৎরাই পথে কালকের দেখা কাঠের পুলটার কাছে নেমে আসি তারপর সেই পুলটা পার করে ডানদিকের চড়াই পথ ধরে এগোতে থাকি। খানিক এগিয়ে পশ্চিমমুখী পথের বাঁপাশে এক ছোট্ট মন্দির। মূল পথ ছেড়ে পায়ে পায়ে উঠে আসি মন্দিরের চাতালে। চারপাশ তাকিয়ে দেখিজনবসতির কোনো চিহ্নই চোখে পড়ে না। মন্দিরটিও তালা বন্ধ। একটু হতাশ হই। পাহাড়ে সূর্যের তেজ খুব চড়া । জল খেয়ে সংগ্রাম কে জিজ্ঞাসা করি। সংগ্রাম বলতে থাকে। সেই কবেকার কথা। নর ও নারায়ণ নামের  দুই ঋষি এই বদরিকা আশ্রমে এসে নারায়ণের তপস্যা শুরু করেন। সেই দুই ঋষির অভাগিনী মা শুধু সন্তানদের চোখে দেখতে পাওয়ার আশায় সেই স্থানে এসে ঘর বাঁধেন। আমি যেন সেই যুগে পৌঁছে গেছি। সেই পাণ্ডববর্জিত পাথরের সমুদ্রে এক মা শুধুমাত্র পুত্রমুখ দর্শনের ইচ্ছায় সেই ভীষণ স্থানে যুগ যুগ ধরে অপেক্ষা করছেন। কথিত আছেবছরে এক বিশেষ দিনে তিনি দুই পুত্রের দর্শন পান। প্রত্যেক বছর শ্রাবনমাসের দ্বাদশী তিথিতে (যা বামন দ্বাদশী নামে পরিচিত) বদ্রীনাথ থেকে তাঁর দুই পুত্র ডোলিতে চেপে মাতৃদর্শনে আসেন। সেই দিনটি সেই মায়ের জন্য সবচেয়ে আনন্দের দিন।সেই উপলক্ষ্যে ঐ দিন মন্দির চত্ত্বরে বিরাট মেলা বসে। তারপর ঋষিদ্বয় আবার বদ্রীনাথে ফিরে যান। আর সেই স্নেহপরায়না মাতৃহৃদয় একাকী সেই ভীষণ বিপদসংকুল প্রদেশে আবার এক বছরের জন্যে সন্তানদের প্রিয়মুখ দর্শনের আশায় অপেক্ষায় বসে থাকেন। সেই জন্য মন্দিরটি মাতৃ মূর্তি মন্দির নামে পরিচিত। শুনতে শুনতে আমার চোখের জল আর বাধা মানলো না । এক আশ্চর্য উপলব্ধি হলো। ঈশ্বর কি এমন বস্তু যার জন্য মাকে এত কষ্ট দেওয়া যায় আর সন্তান কি এমন বস্তু যে যার জন্য পৃথিবীর সব কিছু ত্যাগ করা যায়এই নিষ্ঠুরতার অনুষ্ঠানের একমাত্র সাক্ষী সেই ঈশ্বরযার উপাসনায় পুত্রেরা মাকে এত যন্ত্রনা দিচ্ছে। এই কথাগুলো যত তাড়াতাড়ি ভুলে যাওয়া যায়ততই ভালো। নিদারুন  মানসিক যন্ত্রনায় এই ব্যথাতুর মানব হৃদয়সেই ঈশ্বর আর তাঁর উপাসকদের প্রানভরে অভিশাপ দিলো। তারপর নিজের চোখের জলে মায়ের মনের ব্যথার উপশমের চেষ্টায় মন দিলো। সন্তানের নির্মমতায় মা যে পাথর হয়ে গেছেন। সন্তান আর সন্তাপের মানে কি একদিদিদিদি উঠোমত রোও ইতনাচলোবহত দূর যানা হ্যায়। সংগ্রামের ডাকে যেন স্বপ্ন ভেঙ্গে যায়। কী এক অসহ্য যন্ত্রনা থেকে পলকে মুক্তি পেয়ে বাস্তবে ফিরি মাতৃমন্দিরে সাষ্টাঙ্গে প্রনাম করে পথে নামি। দূর থেকে ডানদিকে বসুধারার স্বর্গীয় ধারা দেখা যাচ্ছে। ঐ ধারাজল সারা ভারতের তপস্যাব্রতীদের বড় সাধনার ধন। কথিত আছে যেপাপী শরীরে ওই জল স্পর্শও করে না। সামনে এক ভাঙাচোরা হিমবাহের ফুটিফাটা পাথুরে অঞ্চল। ঝুরঝুরে পাথর আর বালি মাটির এক বিপদজনক সংমিশ্রণ। ওর ওপর দিয়েই আমাদের রাস্তা। সাবধানেধীরে ওই চড়াইটা পার করে ওপরে উঠে আসি। ডানদিকের খাতে হিমবাহের হাঁ মুখ দিয়ে অলকানন্দা বেগে বেরিয়ে আসছে। এরপর খালি চড়াই আর চড়াই। সাবধানে বোল্ডারের ওপর দিয়ে দিয়ে এগিয়ে চলেছি। পথের অপরূপ সৌন্দর্যবর্ণনার অতীত। ফুলে ফুলে উপত্যকা ভরে আছে। আর হবে নাই বা কেনএ পথ যে স্বর্গের পথসত্যের পথ। এই পথ দিয়েই তো যুধিষ্ঠির সপরিবারে মহাপ্রস্থান করেছিলেন। সমগ্র মহাভারতের মধ্যে এ এক অপূর্ব অধ্যায়। কী উন্নত দার্শনিক চিন্তার সমন্বয়তুমি যেই হওসময় ফুরোলে নিঃস্ব  হয়ে একাকী এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হবে। পিছন ফিরে দেখা চলবে না। এই দার্শনিক চিন্তার এই রকম অপূর্বতুলনাহীন প্রয়োগ আর সারা পৃথিবীতে কোথাও নেই। এই একটি মাত্র পথযা স্বর্গারোহনের পথ হিসাবে চিহ্নিত। এই পথ ঈশ্বর উৎসর্গ করেছেন মানব জাতির উদ্দেশ্যেযে মানুষ নিজেকে ওই স্তরে উন্নীত করতে পারবেওই পথে তাঁরই অধিকার। ভাবতে গিয়ে সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। আবারও এগিয়ে যাই। খানিক এগিয়ে একটা সমতল মতো জায়গা। আজ এখানেই রাত্রিবাস। এই জায়গাটির নাম লক্ষ্মীবন। সবাই মিলে হাতে হাতে তাঁবুগুলো লাগিয়ে ফেলি। তারপর গিয়ে কাছের এক উঁচু পাথরের ওপর বসে পড়ি। আঃ ! আজকের মত পা-দুটোর বিশ্ৰাম। চারপাশে তাকিয়ে দেখিএযে একেবারে স্বর্গের চার রাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছি। ডানদিক থেকে সামনে বসুধারা জলপ্রপাতের ধারা অবিশ্রাম ঝরে পড়ছে। নাপড়ছে নাএলোমেলো হাওয়ায় আঁচলের মতো উড়ছে। সোজা তাকালে অরোয়া অঞ্চলঅরোয়া  নালা শতধারায় বিভক্ত হয়ে অলোকানন্দায় মিশে যাচ্ছে। বাঁ দিকে কোনাকুনি উত্তরগঙ্গা উপত্যকা। সেখান থেকে ভাগিরথী হিমবাহ নেমে এসেছে। আর একদম বাঁ দিকে আমাদের আগামীকালের পথের কিছুটা দেখা যাচ্ছে। পথটা কিছুটা এগিয়ে বাঁ দিকের চক্রতীর্থ উপত্যকার দিকে চলে গেছে। ওই বাঁ দিকে থেকে নেমে এসেছে সতপন্থ হিমবাহ। আর ঠিক যেখানে সতপন্থ ও ভাগীরথী হিমবাহ মিলেছেঠিক সেখান থেকেই অলোকানন্দার উৎপত্তি। সূর্যদেব সামনের উঁচু পাহাড়ের আড়ালে গেলেনআর উপত্যকায় সন্ধ্যার ছায়া নেমে এলো। কোথা থেকে সাদা মেঘের দল সামনের পাহাড়গুলোকে মেঘের চাদরে ঢেকে দিতে লাগলো। অন্ধকারের গায়ে আরও এক পোঁচ পড়লো। দূরেউত্তরগঙ্গা হিমবাহ অঞ্চলের শিখরে তখন সোনারঙ লেগেছে। অন্ধকারে মনে হয় পাহাড়গুলো যেন একটু কাছে এগিয়ে এসেছে। হঠাৎ সেই মায়ের কথা মনে পড়ে যায়। সেই পুণ্যবতী দুঃখিনী মাএকাকিনী এক পাথরের ওপর বসে আছেন। অলকানন্দার পাড়ে বসে আমার এই প্রাচীনঅর্বাচীন ভারতবর্ষের এক পরম্পরাকে বয়ে নিয়ে চলেছেন। কি অসীম সাহসকে বলে নারী দুর্বলমনে মনে সেই মন্দিরের আঙিনার সব ধুলো গায়ে মাথায় মাখি। চোখের জলে চৌকাঠের ওপর মাথা রাখি

রাতে শুয়ে শুয়ে ভাবিকাল বেশি পথ নয়। তারপরেই দেখতে পাবো অলকানন্দার জন্মস্থান। সে পুণ্যস্থানও বটে। হঠাৎ পাহাড়ে গুমগুম গুমগুম শব্দ ওঠে। কাছ থেকে দূরে সে শব্দ প্রতিধ্বনি হতে থাকে। আমি উঠে বসি। সংগ্রামজি.....হাঁ দিদিসাড়া দেয় সংগ্রামআমি বলিইয়ে ক্যা আওয়াজ আ রহা হ্যায়কুছ নেহিদিদিআভালাঞ্চ হ্যায়সো যাইয়ে। সে স্বর্গভূমিতে অভ্যালাঞ্চের গুমগুম শব্দ কেমন দুন্দুভির মতো শোনায়। তারপর থেকে থেকেই সেই দুন্দুভি বাজতে থাকে। তাঁবুর চেনটা খুলে বাইরে উঁকি দিই। আকাশে চাঁদ নেই। মাথার ওপর নক্ষত্রের নকশা কাটা আকাশ। আবছা আলোয় পাহাড়ে হেলান দিয়ে কুয়াশারা গল্প করে ।আমি কান খাড়া করিওরা চুপ করে থাকে। আবার কতক্ষন পর যেন ফিসফাসবিষণ্নতায় ভরা। সেই অলীক নিস্তব্ধতাকে ভেদ করে কার এক গুমরোনো কান্নার শব্দ। সেই ফিসফাসে একটু যেন উত্তেজনাএই অলকার কথাই ধরোজন্মের পর থেকেই বন্দিনী সে মানুষের হাতে। সারা পাহাড় জুড়ে লোভের ফাঁদ পেতেছে তারা। পাহাড়ী নদীদের বন্দি করছেতাদের কোমল শরীর নিংড়ে বিদ্যুৎ তৈরি করছেনিজেদের লোভের পূজায় নদীদের আহুতি দিচ্ছে। কি যন্ত্রনায় যে  নিষ্পাপ নদীগুলো কষ্ট পাচ্ছে। এ জীবনে ওদের আর মুক্তি মিলবে না। এই কান্নাটুকুই ওদের একমাত্র সান্ত্বনা। আবার সব চুপচাপ। .....কিন্তু একদিনএকদিন সব অত্যাচারীদের মতোই এদেরও চরম শাস্তি হবেসেই আশাতেই তো অলকা এখনও বেঁচে আছে। ওর দুচোখে যে এখনও সমুদ্রের স্বপ্ন। কী শুনছি এসবহায় ভগবানএরা কারাকিছু ক্ষুদ্র লাভের আশায় মানুষসমগ্র মানব জাতির জন্য কি ভয়ানক অভিশাপ কুড়িয়ে আনছে?

দিদি, উঠোউঠে বসি। ভোর বেলা কখন যে চোখ লেগে গেলইয় লো চায়। চা খেয়ে হাঁটা শুরু করি। কালকের কথা গুলো মাথার মধ্যে ঘুরে ফিরে আসছে পথ তো বেশি নয়পথের নেশাটাই বেশি। অবশেষে পৌঁছে গেছি। অনেক নীচে দুই হিমবাহের সংযোগস্থলের সিংহদুয়ার খুলে হিমালয়পুত্রী অলকানন্দার শিশু ধারা তিরতির করে বেরিয়ে আসছে। হিমবাহ-মায়ের কোলে বসে সমুদ্রের পথের ঠিকানা জেনে নিচ্ছে সে। মায়ের আশীষ মাথায় নিয়ে ঐতো সে এগিয়ে চলেছে। সে জানে নাপথের ফাঁদের কথা। একটু পরেই সে সারা জীবনের জন্য বন্দি হয়ে যাবেএটাই তার ভবিতব্য। মানুষ তার কৃত  পাপের কর্মফল স্বরূপ পৃথিবী থেকে একদিন নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবেনিশ্চিতরূপে। এটাও ভবিতব্যআমি দেখতে পাচ্ছিহিমবাহ-মা তাকিয়ে দেখছেন তাঁর সন্তানের চলে যাওয়াসে আর কোনোদিন ফিরবে না তাঁর কোলে। উজানে যে আর ফেরা যায় না















বৃহস্পতিবার, ১৬ জুলাই, ২০২০

এক মিলনগাথা !!

খেরকুটিয়া নদীর নীল জলে হাঁস চরে। দূরঘাট দিয়ে নৌকো যায়। নদীর অলস স্রোতে কচুরিপানার ভেসে আসা, ভেসে যাওয়া; আমি ভাবি, এই আমার দেশ, আবার দেশ নয়। আমাদের হুরে দিশাহীন জীবনে এই দৃশ্য যেন কোনো পুরোনো বইয়ের ছেঁড়া পাতা।

হেমন্তের মাঠে ধান কাটার মনোরম দৃশ্য। পড়ন্ত  রোদে মহিলারা ধান কাটায়  ব্যস্ত। পুরুষরা সেই ধান-কাঁধে বাড়ির পথে। এই ধান থেকে চালে পৌঁছনোর রাস্তা বড় সোজা নয়। প্রথমে ছড়া থেকে ধান আলাদা করা, তারপর অনেক পথ পাড়ি দিয়ে তবে সে চাল হয়। সে যাই হোক, আসল কথা হলো, এই যে ধান  কাটা আর মাঠ থেকে বাড়ির উঠোন, এই চলনের ছন্দটা আমাকে একটা যেন আনন্দের আবেশ দিয়ে ঘিরছে। আমার আজ বিকেলের এই অলস অবসর আমাকে যেন পূর্বজন্মের স্মৃতি মনে করাচ্ছে।

লুইট নদী লোহিতের আদরের নাম; কেমন শান্তটি  হয়ে শুয়ে আছে। ছোট ডিঙি নিয়ে দিনের শেষে নদী হাতড়ে বেড়ায় গাঁয়ের মানুষ। দূরে  জাল পাতা। এক মেছোবক জলের দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবছে। নদীর চড়ায় দুটো শামুক ভাঙা পাখি। দাঁড়িয়ে আছি বাঁশের সাঁকোয়, একটু ঝুঁকে মাঝিকে সুধোই, কি পাইলা, মাঝি? আমার ওই টুকু নড়াতেই সাঁকোয় খচরচর, নিজেকে সামলাই কোনোমতেমাঝি হাসে, বলে, ভিনদেশি  দেখি, বাসা কইহানে? কলকাতা, অয়,পাইসি কয়খান বরিয়ালা। উত্তরবাংলায় বরোলি শুনেছি, বরিয়ালা শুনিনি। জিজ্ঞাসা করব, তার আগেই ডিঙি এগিয়ে গেছে নদী বেয়ে। 

আজ যাবো, মাজুলি। একা মানুষ, পথে এপা ওপাশ তাকাই। নিমাতি, নিমাতি, নিমাতি  শুনে এগিয়ে যাই গাড়ির দিকে। যাইবেন নাকি? হ্যাঁ, কমলাবাড়ি ঘাট। অ, কমলাবাড়ি, কৈ যাইবেন, মাজুলি? হ্যাঁ, কেউ থাহে? নাএকা আইসেন? হ্যাঁবয়েন, বয়েন। ভিতরে ঢুকে বসি। গাড়ি চলে। বাজার ছাড়িয়ে পাড়া ছাড়িয়ে গাড়ি ধান ক্ষেতের মাঝ বরাবর পাকা রাস্তা দিয়ে ছুটে চলে। মাঠভরা পাকা ধান, হেমন্তের সোনালী রোদ সব মিলিয়ে যেন কেমন যেন নেশা লাগে। পৌঁছলাম কমলাবাড়ি নিমাতি ঘাটে। সামনে ব্রহ্মপুত্র, বিশাল ডানা মেলে শুয়ে আছে। দূরে তাকাই, যতদূর চোখ যায়, ধু ধু বালির চর। শুশুক লাফায়। টিং টিং টিং টিং, ওরে বাবা নৌকো ছাড়বে, তাড়াতাড়ি টিকিট কেটে নৌকোয় উঠি। গাড়ি, লরি সব নিয়ে সেই নৌকো চলেছে মাজুলি।

নৌকো ব্রহ্মপুত্রের বুক চিরে এগিয়ে চলেছে। নদীর বুকে পলি পড়ে চড়া। সূর্যের আলোয় চড়ার বালী চিক চিক করে। হঠাৎ কেন জানি বাবার কথা মনে পড়ে। দেশভাগের আগেই কর্মসূত্রে এপারে চলে আসা। কলকাতা শহর। আদি বাড়ি ছিল বরিশালে। সেখানে চেনা সুখ চেনা দুঃখের আটপৌরে জীবন। বাংলা দেশের কথা তারা কোনোদিনই ভুলতে পারেন নি। ছোট বেলা থেকেই আমরা সেই বরিশাল, মেঘনা, ব্রহ্মপুত্র শুনেই বড়ো হয়েছি। বাবা আজ আর নেই, কিন্তু আজও ওই বাড়ি সেই পূর্ব বাংলার গল্প বলে। আমরা কোনো দিনই বাংলা দেশে যাই নি, শুধু শুনে শুনেই এক ঘুঘু ডাকা ছায়ায় ঢাকা ছোট্ট গ্রামের ছবি মনে আঁকা হয়ে গিয়েছিল। আর ছিল এক নদী, তার নাম কীর্তনখোলা। এমন সুরেলা নামের নদীর নাম আর কখনও শুনিনি। সেই নামখানি মনের ভিতরে যেন একখানি নকশিকাঁথা হয়ে বিছিয়ে আছে। বাবার কাছে শোনা, শীতের দুপুরে কীর্তনখোলার জল জোয়ারের টানে প্রায় উঠোনে উঠে আসত। সেই সুপুরি নারকেল গাছে ঘেরে গ্রাম্য জীবন নদী আকাশ মানুষের সাথে এক অদ্ভুত বন্ধনে আবদ্ধ ছিল। জেগে আছ, নাকি ঘুমোলে? কে ডাকে? চারপাশে তাকাই, না,কেউ তো নেই। ভাবনার সুর কেটে যায়। নদীর কোলে উঁকি দিই, চিনতে পারো আমায়? নদীর হাওয়ায় ব্রহ্মপুত্রের ইশারা। ডাকলে আমায়? কত কাল পরে দেখা। আমি আশ্চর্য হই, কি করে চিনলে আমায়? নদীতে কুলুকুলু, বলে, চিনি নি, শুনেছি। কীর্তন আমায় ডাক দিল যে। অবাক হয়ে বলি,তু মি ওকে চেনো? .........সে যেন শুনতেই পেলো না, কীর্তন তোমার শরীরের শিরা উপশিরায় বয়ে চলেছে, মনে, চেতনা অবচেতনে সে তোমার সাথে জড়িয়ে আছে, বলে চলে সে। আমার চোখ জলে ভরে ওঠে, অজান্তেই। কিন্তু, তাকে তো আমি কোনো দিন দেখিই নি,এইতো, এইতো আমিবলতে বলতে চোখ দিয়ে সে অঝোর ধারায় বেরিয়ে আসে, আমার ভিতরে মোচড়ের পর মোচড়, বুকের ভিতরের নকশিকাঁথাটান পড়ে কীর্তনকে বুকে পেয়ে হেমন্তের ব্রহ্মপুত্র খুশিতে কলকলিয়ে ওঠে, এইবার আমরা বেশ সবাই সবাই হলাম। নৌকো আপন মনে উজিয়ে চলে ব্রহ্মপুত্র বেয়ে...........মাজুলির দিকে। 

সোমবার, ১৩ জুলাই, ২০২০

সেই দরজাটা !!

হাঁটছি পাহাড়ে। উপরে উঠছি ধীরে ধীরে। উচ্চতার সাথে সবুজ কমে আসছে। প্রায় তিনটে বাজে। বেলা ক্ষয়ে আসছে। আরও অনেক পথ এখনো বাকি। আলো থাকতে থাকতে পৌঁছতেই হবে। এক অশেষ ক্লান্তি ধীরে ধীরে সারা শরীরকে যেন আচ্ছন্ন করে ফেলছে। তবুও থামা যাবে না। এক অমোঘ অনিবার্য কারণে এগিয়ে চলি। পাহাড়ে চড়ার একটা নিয়ম আছে। সামনের দিকে ঝুঁকে চড়াই পথ চড়তে হয়। আমিও সেই নিয়মের ব্যতিক্রম নয়। হঠাৎ থামতে হয়, পথ থেকে চোখ তুলে দেখি সামনে আর পথ নেই। দাঁড়িয়ে আছি এক বিরাট বন্ধ দরজার সামনে। আর এগোতে গেলে সেই দরজা পার করতে হবে। কেউ কোথাও নেই। দাঁড়িয়েই আছি। ওপর থেকে নাকি ওপার থেকে নাকি হাওয়ায় এক স্বর ভেসে এলো, অপেক্ষা করো।

ঘুমটা ভেঙে গেল। এদিকে গলা শুকিয়ে কাঠ। জল খেয়ে স্থির হয়ে বিছানায় বসলাম। মাথার মধ্যে সেই  বন্ধ দরজা..................

তারপর কত কত দিন কেটে গেছে। কিন্তু মাথার ভিতরে দরজাটা বন্ধই রয়ে গেছে। কতবার হিমালয়ে গেছি। নদীর ধারে ধারে, পাহাড়ের সবুজ চারণভূমিতে, যেখানে ঝর্ণার ধারামুখ দিয়ে বরফগলা জলের ধারা বেরিয়ে আসছে, খাড়া পাহাড়ের গায়ে ছোট-বড় কত গুহামুখ, যেখানে পাহাড়ি পশুপালকরা ছাগল ভেড়া নিয়ে রাতে আশ্রয় নেয়; কিন্তু না, কোথাও কোনো দরজা দেখিনি আমি

তারপর সময়ের সাথে সাথে সেই বন্ধ দরজার স্মৃতির ওপর ধুলো জমে। সময়ের নিয়মে স্মৃতিও ঝাপসা হয়ে আসে

‌দিন তো থেমে থাকে না। সারা পৃথিবী জুড়ে ঘটনার ঘনঘটা। আজ যা ঘটেছে, আগামী কাল তাই অতীত হয়ে যাচ্ছে। এত বেশি ঘটনা ঘটছে যে ঘটনার পরম্পরা  বলে কিছু থাকছে না। দৈনন্দিন জীবনের গতিও এত বেড়ে গেছে, সমাজেরও দিশাহারা অবস্থা। সব ঘটনা প্রত্যক্ষও হয়তো নয়, তবুও প্রাত্যহিক খবরের কাগজের কালোকালির শব্দগুচ্ছ মনের উপর কিছু আঁকিবুঁকিতো কাটে

‌কাগজ খুললেই  আমাজনের জঙ্গলের আগুন, কোথাও বিধ্বংসী ঝড়, কখনও হিন্দুকুশে পঙ্গপালের আক্রমণ। পৃথিবী জুড়ে প্রকৃতির মহাতাণ্ডব। এরমধ্যে মানুষও কম যাচ্ছে না। কখনও ভেনিজুয়েলার গৃহযুদ্ধ তো কখনও চিনদেশে উইঘুরদের ওপর রাস্ট্রচাপ

‌মোটের ওপর সহজ কথা হলো মৃত্যু কালে প্রবেশ করেছি আমরা। আমাদের চারপাশে মৃত্যু হানা দিয়ে ফিরছে, সে যেরূপেই হোক। মানুষে, প্রকৃতিতে মিলে এক মহাখেলায় অংশ নিয়েছে। যুযুধান দুই প্রতিপক্ষ একে অপরকে ধ্বংসের এক ভয়ংকর প্রতিজ্ঞা করেছে। ঈশ্বর দেখছেন; দুজনকেই তিনি পরম যত্নে সৃষ্টি করেছেন, প্রকৃতি-সত্বা এবং মানবসত্ত্বা দুয়ের  মধ্যেই তো তিনি, তবে কেন এই বিপর্যয়?

‌ওই দেখো, মৃত্যু কেমন তাড়া করে ফিরছে, পালাচ্ছে মানুষ। কোথাও কাঁটাতার পেরিয়ে, কোথাও ডিঙি চড়ে অকুল সমুদ্র পাড়ি....জীবনের মায়া বড়োই রহস্যময়। দৌড়ও আরো জোরে, পিছনে মৃত্যু। তার কোনো তাড়া নেই

‌এদিকে তাকাও, হাজার হাজার পা হেঁটে চলেছে রাজপথ দিয়ে, রেলপথ ধরে। বাড়ি যেতে চায় তারা। এরা কারা? কবি বলছেন, এরা দেবতা, এরা মানুষ, এরা কুলিমজুর, কল-কারখানার শ্রমিক। এরা সভ্যতার বাহক, এরা ছাড়া সভ্যতা অচল। অথচ আজ এদের পরিচয় শ্রমিক নয়, এক আজব শব্দের খাঁচায় এরা বন্দি, পরিযায়ী। সভ্যতা কত নৃশংস হলে এই শব্দ সমাজে মান্যতা পায়? নিজের দেশের মধ্যেই কি ভাবে তারা পরিযায়ী হয়ে গেল, তবে কি এই দেশ তাদের দেশ নয়? তাদের মনের এই যন্ত্রণা কিসের উত্থানের ঈঙ্গিত বয়ে আনছে? ওরা আর আমরা, সেই স্বপ্নে দেখা দরজাটার এপার, ওপার

‌সেই ছোট্ট মেয়েটা, ছোট্টো ছোট্টো দুটো পায়ে শত শত মাইল হেঁটেছিলো, শুধু বাড়ি ফিরবে বলে। গ্রামে পৌঁছনোর মাত্র চোদ্দ কিলোমিটার আগে পথেই মরে গেল। আসলে মৃত্যু ও তার কষ্ট দেখে থাকতে পারেনি, ছুটে এসে তাই কোলে তুলে নিয়েছিল। সেই শিশুটি নাবালিকা ছিল, শ্রমিকও ছিল। পুরোটা লিখলে দাঁড়ায় যে, নাবালিকা শিশুটি পরিযায়ী শ্রমিক ছিল। ভারতে এমন কত শিশু শ্রমিক আছে, কেউ তো জানেই না। মেয়েটি ভাগ্যিস মরে গেল, তাই তো এই আশ্চর্য কথাটা জানা গেল

‌ঈশ্বর হাসছেন। ঈশ্বর হাসছেন। মানবজাতির প্রতি স্নেহে, তার শিশুসুলভ আচরণ দেখে তিনি কৌতুক বোধ করছেন। পৃথিবীতে মানবজাতিই তো পরিযায়ী। কোথা থেকে এসেছে কেউ জানে না, কোথায় যাবে তাও জানা নেই। পৃথিবীতে এসে নিজের নিজের কর্ম করছে, তারপর কর্ম শেষে ঠিক ওই শ্রমিকদের মতো নগন্য হয়ে সব ফেলে রেখে চলে যেতে হবে। প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলেই এই পৃথিবী সব সম্পর্ক অস্বীকার করবে, ছুঁড়ে ফেলে দেবে কালের করাল মুখে, ফিরেও দেখবে না

‌আজ আমার সামনে সেই বিরাট দরজাটা  আবার দেখতে পাচ্ছি যেন। এবার চাবিটা বোধহয় পেয়েই যাবো, অথবা দরজাটা নিশ্চিত খুলেই যাবে

শনিবার, ১১ জুলাই, ২০২০

করোনার পটে সমাজচিত্র !


যদি ধরে নেওয়া যায় যে আর পাঁচটা ভাইরাস ঘটিত রোগের মতো করোনা ও সময়ের সাথে বিদায় নেবে, তবে তো খুবই ভাল কথা; আর যদি না যায় তাহলে ? অথবা যদি চলেও যায়, তাহলে কোথায় যাবে, মানে যেতে পারে ? আমেরিকা না চীন, নাকি মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি, নিদেন কাছের চাঁদেও যেতে পারে; যেখানে পারে যাক আমরা একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচি, উঃ, উফ! ওরে একটু বাতাস কর, দেখি করোনা  কি দিয়ে গেল ? ওরে, কে আছিস, জমা খরচের খাতাটা একটু নিয়ে আয়, দেখি

আহা, পেয়েছি এক ছুটি-ঋতু সারাদিন অখণ্ড অবসরে খবরের কাগজের প্রতিটা শব্দ ধরে ধরে চিবিয়ে তার সব রস নিংড়ে বার করছি হুঁ  হুঁ বাবা, মনের খুব পুষ্টি হচ্ছে মাঝে মাঝে বদহজমও হচ্ছে, তবে কিনা বাড়িতেই আছি তো, সামলে নিচ্ছি আহা, কত খবর, রোজ সকাল থেকে রাত পর্যন্ত একই খবর বার বার পড়তে থাকি তারপর একদিন হঠাৎ এক আশ্চর্য জিনিস খেয়াল করি  মার্চ মাসের করোনা সংক্রান্ত খবরের থেকে আজকের দিনের কাগজের করোনা সংক্রান্ত খবর বিলকুল আলাদা যেমন তখন খবরের কাগজগুলো লিখে ছিল করোনা ভাইরাস চীন বানিয়েছে সেই নিয়ে চারদিকে খুবই উত্তেজনা সাবধানে সাবধানে সব বাজার, অফিস যাওয়া আসা তার মধ্যেই আবার হাত ধোয়া শুরু হলো তারপর বিদেশ থেকে সব বাড়ি ফেরানো শুরু হলো ঘরের ছেলেরা ঘরে ফিরে আসতে লাগলো

তারপর আরেক দিনের কথা ততদিনে করোনা দেশবিদেশে ছড়িয়ে পড়েছে আমাদের দেশে কেরালাতেও প্রথম রোগী চিহ্নিত করা গেছে সরকারিভাবে সমস্ত রকম সতর্কতা জারি হয়েছে তারপর, করোনা এক শুভক্ষণে কি করে যেন কলকাতায় পৌঁছলো তারপর, সে এক ভারী গোলযোগ উপস্থিত হলো আবার খবরের কাগজ মারফত জানা গেল যে করোনা সোজা নবান্নে পৌঁছে গেছে কি আপদ!

পরের দিন সকালে চায়ের কাপ নিয়ে সবে কাগজটার প্রথম পাতায় চোখ রেখেছি, এক উচ্ছপদস্থ্য আমলা তার বিদেশ থেকে আগত করোনা পজিটিভ পুত্রকে নিয়ে নবান্নে বেড়াতে এসেছিলেন তারপর এঘর ওঘর সব ঘর বেড়িয়ে নবান্ন থেকে সরকারি গাড়িতে করে বিভিন্ন জায়গায় কাজ সারতে সারতেসারা হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেল, চোখ ঝাপসা হয়ে এলো এইসবের মাঝে চা টাও ঠান্ডা হয়ে গেল

তারপর মিডিয়াগুলোতে ভীষণ রাগারাগি, গালাগালি চললো তারপর, সময়ের স্রোতে সব স্মৃতি ভেসে গেল আহা, বেশ বেশ

এদিকে, করোনা কেরালা ছেড়ে ধীরে ধীরে মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক, দিল্লি ছুঁয়ে বাকি রাজ্যগুলোতেও পৌঁছে গেল সরকারি নির্দেশে মোমবাতি জ্বালানো হলো, কাঁসী বাজানো হলো করোনা গেল না দেশজুড়ে বাজিও ফাটানো হলো এরমধ্যে শোনা গেল , গোমূত্রে করোনা সারবে অতি সাবধানী মানুষজন সেটাও পান করে হাস্পাতালে ভর্তি হলো

আবার সরকারি কড়া নির্দেশ জারি হলো, গোমূত্র নয়, অসুস্থ হলে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে তারপর, লকডাউন হলো; যে যার সামর্থ অনুসারে চাল ডাল কিনে ভয় মিশ্রিত সুখে শান্তিতে বাড়িতে ঢুকে দোর দিলো

কি আশ্চর্য, গল্পটি ফুরোলেও নটেগাছটি তো মুড়োলো না, বরং ডালপালা ছড়িয়ে সে মাথাতেও বাড়তে লাগলো

সারা দেশে কল-কারখানা বন্ধ হলো কর্মচারী ছাঁটাই শুরু হলো প্রচুর মানুষ কর্মহীন হলো কর্মহীন মানেই বেতন বন্ধ কিন্তু, বেতনহীন হওয়া মনে তো ক্ষুধা তৃষ্ণাহীন হওয়া নয় তাই ক্ষুধায় তৃষ্ণায় সেই মানুষগুলো নিদ্রাহীন হলো তারা ভয়ে দিশাহারা হয়ে গেল তাদের শেষ আশ্রয়স্থল বাড়ি, তারা বাড়ি ফিরতে চাইলো তারপর, দুরদর্শন আর খবরের কাগজগুলোর  মিলিত প্রচেষ্টায়  আশ্চর্য নির্মম খবর চিত্রসহ পরিবেশিত হতে লাগলো, দিনের পর দিন তারপর, সেই দুঃস্বপ্ন আমরা চাক্ষুষ করলাম রেললাইনে ট্রেন চলছে না, লকডাউনে ঘরমুখী মানুষ সেই লাইনের উপর দিয়ে হাঁটছে দু-দশ মাইল নয়, কয়েকশো মাইল; হাতে ব্যাগ, কোলে শিশু আচ্ছা, বলুন তো, কত কত  মাইল হাঁটলে তাকে মানুষ বলা যায় ? কেউ  বলতে পারেন ? বড়জোর দুটো রুটি আর এক বোতল জল সম্বল করে দিনে হেঁটে রাতে ক্লান্ত শরীরগুলো রেললাইনকেই বিশ্রামের আশ্রয় করেছে রেলের লাইনের ওপরেই মানুষগুলো ঘুমিয়ে পড়েছিল পরেরদিন দেশের সব সংবাদমাধ্যমে প্রথম পাতায় রেললাইনের ওপর ছড়িয়ে থাকা তাদের চটি আর রুটির ছবি দেখে সারা দেশ বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল তারা হয়তো স্বপ্নই দেখছিল বাড়ির, কে বলতে পারে ? যে ট্রেন লকডাউনের জন্য চলেনি, সেই ট্রেনই রাতের অন্ধকারে তাদের না-ফেরার দেশে পৌঁছে দিলো! আর তারা কোনোদিন বাড়ি ফিরবে না

তার মাঝে, গোদের ওপর বিষফোঁড়া, আমফান! উঃ, প্রকৃতি এত জ্বালাতনও করতে পারে।ও এদিকে আসবে না, হয় উড়িষ্যা যাবে নাহলে সুন্দরবন ছুঁয়ে বাংলাদেশ চলে যাবে, বরাবর দেখে এসেছি কি বললে ? আবহাওয়া দপ্তর বলেছে, এবারের এই ঝড়টা কলকাতার ওপর  দিয়েই যাবে যতই বলুক, ফোনির বেলাতেও বলেছিল অফিস ছুটি হয়ে গিয়ে ছিল, ঐরকম কিছু একটা হবে তারপরে আমাদের সব ইতিবাচক ভাবনায় নোনাজল ঢেলে, আমফান কলকাতার ঝুঁটি ধরে নেড়ে দিয়ে গেল বিদ্যুৎ নেই, জল নেই, গাছ নেই আরও কত কি নেই নেই সারা কলকাতা শ্মশানভূমি কয়েক হাজার গাছ পড়ে গেল চারদিক লণ্ডভণ্ড তারপর জানা গেল, সুন্দরবনের চরম ক্ষতি হয়ে গেছে, শেষ হয়ে গেছে সুন্দরবন যাক গে, কলকাতাকেই বাঁচানো যাচ্ছে না, তো সুন্দরবন সব খবরের কাগজ কোম্পানিগুলোর কপালে ভাঁজ পড়ে গেল, এই লকডাউনের মধ্যে এত খবর  কি ভাবে ছাপা হবে, ছাপার কাগজ বাড়ন্ত যে সংবাদ মাধ্যমে দেখতে পেলাম সবাই কেমন সবাইকে বকতে লেগেছে এই বকাবকি, দোষের চাপান-উতরের মাঝে হেলে পড়া কলকাতাকে আবার সোজা করা হলো কলকাতা আবার সেজেগুজে করোনার সমস্যা নিয়ে দিনযাপনের বারমাস্যা গাইতে লাগলো

সেই নটেগাছটা মাথায় বেশ উঁচু হয়েছে তার উপরে উঠে চারপাশটা বেশ দিব্বি দেখা যায় সেই গাছের অনেক ওপর দিয়ে উড়োজাহাজে করে শত শত মানুষ প্রতিদিন দেশে ফিরে আসছে খবর-ব্যাবসায়ীরা সেখানেও উঁকি মেরে দেখে বিমানবন্দরগুলোয় আরেক চিত্রনাট্য বিশ্বের সব থেকে পুরাতন অথচ চির নতুন সেই বিভাজন, গরিব ও ধনীর  পাঁচালি ধনীর জন্য স্যানিটাইজার, গরিবদের গায়ে ক্লোরিনের জল ছেটান হলো মানুষের প্রতি মানুষের কি অপূর্ব গণতান্ত্রিক ভালোবাসার প্রদর্শন

রোজ এই মনোরম ছুটির আবহাওয়ায় খবর বিক্রেতারা পসরা সাজিয়ে  এই সব গুরুত্বপূর্ণ খবর বিক্রী করতে লাগলো যারা ওই দিন-আনা-দিন-খাওয়া মানুষ নয়, তারা আহা, উঁহু, কি কষ্ট, চোখে দেখা যায় না, বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে পড়লো

এরপর, করোনা নাটক আরও চমৎকার ওই যে পরিযায়ী শ্রমিকগুলো, যাদের ধৈর্য্য বলে কিছু নেই, তারা মৃত্যুর হাত শক্ত করে ধরে করোনাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে যে যার বাড়ির দরজায় শেষ পর্যন্ত পৌঁছে গেল; কিন্তু না, বাড়িতে ঢুকতে পারলো না কারা যেন কানে কানে ফিসফিস করে বললো, ওরা সব করোনা পজিটিভ অমনি, সেই ফিসফাস আর রইলো না চারদিক কাঁপিয়ে সেই শব্দ, ঠিক, ঠিক, ওই গরিবগুলোই তো করোনা ছড়াচ্ছে কতোদিন স্নান করেনি, জামাকাপড় ছাড়েনি, ওই ওদের জন্যই তো রোগ ছড়াচ্ছে।হতে পারে

কিন্তু কথা হচ্ছে যে, যারা বিদেশ থেকে ফিরছে তাদের এই বিষয়বস্তু থেকে দূরে রাখা হয়েছে কেউ এই বিষয়ে কোনো কথা বলছে না কেউ এ কথাও বলছে না যে এই অসুখ গরিব এই লোকগুলো কোথায় পেলো ? তারা তো কেউ বিদেশে যায় নি, আর করোনাও তো ভারতবর্ষে জন্মায় নি!

যাই হোক, সে………ই যে শ্রমিকগুলো,পনেরদিন নির্বাসন পেরিয়ে করোনায় না মরে, না মরে বলছি কারণ, কোনো সংবাদ মাধ্যমে এই খবর ছাপা হয় নি, যে যার বাড়ি ফিরে গেল

এইবার, এক আনন্দ সংবাদ পাওয়া গেলো লকডাউন উঠে যাচ্ছে কেন লকডাউন হয়েছিল ভুলে গিয়ে, আহল্লাদে ষোলখানা হলাম উল্টো-কুলোর হাওয়া দিয়ে করোনা এবং করোনা ভীতিকে মৌসুমী হাওয়ায় ভাসিয়ে আবার চায়ের কাপ নিয়ে বসলাম তারপর, বাঁ হাত দিয়ে মুখের পট্টি সরিয়ে চায় চুমুক দিলাম এই করোনার জ্বালায়  চা খাওয়া প্রায় বন্ধ হয় আর কি! বলুন তো, চা খাবো না আমরা, খাবো না আমরা চা ? ঐতো, সেই নটে গাছের ডালপালাগুলো দেখা যাচ্ছে, ছোট ছোট ফলও ধরেছে। আচ্ছা, নটেফল কি খায় ?

এই তুই কে রে ? বাড়িতে ঢুকলি কি করে ?

আজ্ঞে, আমি করোনা

আমি যাই নি, যাচ্ছি না, যাবোও না

বৃহস্পতিবার, ৯ জুলাই, ২০২০

দুয়ার খোলার সকাল !




আমরা যারা পঞ্চাশের কোটা পার করেছি, জীবনে এগিয়ে চলার সাথে সাথে আমরা একটা খেলাঘরের বৃত্ত তৈরি করেছি । সেখানে একটা সিঁড়িও আছে । সেই সিঁড়ি দিয়ে নেমে মাঝে মাঝেই ছোটবেলায় পৌঁছে যাই । যেমন আজকের সকালে। আমাদের পৃথিবীতে এখন আতংকঋতু যাপন চলছে । কতদিন চলবে কেউ জানে না । সকলে ছাদে উঠে দেখি, দূরে রেল লাইনের ধারের কৃষ্ণচূড়ার লাল মাথাগুলো দেখা যাচ্ছে, হালকা হাওয়ায় নীল আকাশে হেলান দিয়ে হাসাহাসি, কিন্তু কারণটা বোঝা যাচ্ছে না । আতংককাল যাপনের কথা ভুলে পথে বেরিয়েই পড়লাম । মুখে মুখোশ পরে, হাতে ক্যামেরা নিয়ে, কৃষ্ণচূড়ার পাড়ার দিকেই পা বাড়ালাম । পথে পড়ল রেলের লাইনের ধারে এক মস্ত ঝিল । তার ধারে ধারে নানা বনফুলের ঝোপ । আজ আড়াই মাস পরে নতুন করে দেখা । জিজ্ঞাসা করে, “কেমন আছো ? কতদিন দেখিনা।পথ বদলালে না কি?” কিবা আর উত্তর দি, হাসিটুকু ছাড়া । হঠাৎ দেখি, জলের নড়াচড়া । ওমা , এক তেচোখো মাছ । ঐ তো, ওর পেছনে আরও একটা । লেজ নাড়া থামিয়ে আমার দিকেই তাকিয়ে আছে । কতদিন পর তেচোখো মাছ দেখলাম । এক দৌড়ে সেই সিঁড়িটা দিয়ে নেমে আসি ছোটবেলায় । স্কুল যাওয়ার পথে ওদের সাথে দেখা হয়নি, এমন দিন মনেই পড়ে না । তখন ওরা গ্রামের সব পুকুর, ঝিলেই যৌথ পরিবারে বাস করত । দল বেঁধে, ঝাঁকে ঝাঁকে ঘুরে বেড়াত । ওদের চারপাশে চারপেয়ে জল মাকড়সারা জলের ওপর স্কি করে বেড়াত ।
আরে, ওটা কি ? একটা জল শামুক, কেমন জলের দোলায় ভেসে আসছে । কি সুন্দর যে একটা জলছবি তৈরি হয়েছে ! কাছাকাছি হতেই তেচোখো ওকে সরে গিয়ে পথ করে দিল । ওরাও শামুকটাকে দেখছিল । শামুকটা ভাসতে ভাসতে এক কচুরিপানায় আটকে গেল । কচুরিপানায় আড়াল হওয়ায় তেচোখো আর শামুকটাকে দেখতে পাচ্ছিল না । ওমা, কি বুদ্ধি দেখ ! এগিয়ে এসে পাতার পাশ থেকে উঁকি মেরে দেখছে । শামুকটাকে ভাল করে দেখতে গিয়ে দেখি, আগে থেকেই আরও একটা শামুক পাতার তলায় আটকে আছে । এই বার বুঝেছি, আটকে থাকা শামুকটা হাওয়ায় হাওয়ায় খবর পাঠিয়েছিল, তাই দ্বিতীয়টি জলে জলে ভেসে এল । শামুকদুটিকে একসাথে দেখে, তেচোখো দুজন গল্প করতে করতে কোথায় যেন চলে গেল । আমার আর কৃষ্ণচূড়ার কাছে যাওয়া হল না ।

কবিতা ৮ ।

 সপ্তসিন্ধু পার করে লখিন্দর ফেরে ঘরে।সাথে করে  বিবিধ রতন। শঙ্খ বাজে, উলু দেয় এয়োতি, পুরজন। বাপ তার, চন্দ্র সওদাগর। লখার সাফল্যে মুখে তার  গো...