রবিবার, ২২ নভেম্বর, ২০২০

নচিকেতা তাল !

 

আজ থাকবো উত্তরকাশীতে। হরিদ্বার থেকে একশো পঁচাত্তর কিলোমিটার পথ। বিকেল গড়িয়ে গেছে। গাড়ি থেকে নেমে জিজ্ঞাসা করবার জন্য এক চায়ের দোকানে দাঁড়াই। চা খেতে খেতে দোকানিকে শুধাই ‘আর এখানে কি দেখার আছে?’ জানতে পারি এখানে একটি অল্পশ্রুত স্থান আছে, ‘নচিকেতা তাল’। বাকি সব খবরও নিলাম, ফেরার পথে যাব। 

ফেরার পথে উত্তরকাশীতে নামলাম। পরের দিন খুব ভোরে, প্রায় সাড়ে চারটের সময় বেরলাম, গন্তব্য নচিকেতা তাল। এই উত্তরকাশী থেকে যে রাস্তাটা লম্বোগাঁও হয়ে কেদারনাথের দিকে গেছে সেই রাস্তায় খানিক গিয়ে চৌরঙ্গীখাল। এখানে চৌরঙ্গীনাথের এক মন্দির আছে, সেই মন্দিরের পাশ দিয়ে এক জঙ্গলের পথ। কোথাও কোনো জনমানুষ দেখা যায় না। উত্তরকাশীতে বলেছিল, ঐ রাস্তা দিয়ে মোটামুটি তিন কিলোমিটারের মধ্যেই নচিকেতা সরোবরের দেখা পাওয়া যাবে। আমরা ঐ পথ ধরে ধীরে ধীরে জঙ্গলে প্রবেশ করলাম। পরিষ্কার জংলী পথ। ঝরাপাতায় ঢাকা। ক্রমে গভীর থেকে গভীরতর জঙ্গলে ঢুকে পড়েছি। পাহাড়ী ঝিঁঝিঁর সমবেত গানে চারপাশ মুখর হয়ে আছে। আমাদের সাথে কোনো পথ প্রদর্শক ছিল না। ভরসা করার মতো বলতে দুটো লাঠি ছিল। পথরেখা ধরে এগিয়ে চলেছি। সকালের বনপথে ভালুকের ভয় আছে। একটা করে মোড় ঘুরছি আর মনে হচ্ছে এই বুঝি সামনে কাউকে দেখতে পাব। পথের বৈচিত্র বলতে শুকনো পাতার ঝরে পড়া, ঝিঁঝিঁর সমবেত সঙ্গীত আর এক একবার দমকা ঘূর্ণি হাওয়ায় শুকনো পাতার ওড়াউড়ি। অবশেষে পথ শেষে এক সবুজ খোলা মাঠের মতো জায়গা। সেই ফাঁকা অঞ্চলটুকুও পার হলাম। সামনে হঠাৎ এক জলাশয়। বড় বড় প্রাচীন গাছের ছায়ায় ঢাকা। দাঁড়িয়ে চারপাশটা ভাল করে দেখি। জলাশয়ের গঠনটা একটু লম্বাটে। ডান দিকে একটা ছোট ঘর, ছাউনি দেওয়া। আমারা পায়ে পায়ে সেই সরোবরের ধারে। হঠাৎ পিছন থেকে হুংকারসম শব্দ। ‘কিঁউ আয়ে হো ইধার?’ চমকে তাকিয়ে দেখি সর্বাঙ্গে ভস্মমাখা জটাজুট এক ঋষি মূর্তি। ‘প্রণাম, বাবা’, শুনতেই পেলেন না যেন। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি। আগুন ঝরছে সেই দৃষ্টিতে।  ‘কিঁউ আয়ে হো?’ একটু মনে সাহস যোগাড় করে বলি, ‘নচিকেতা তাল দর্শন করনে কে লিয়ে’। ‘লেকিন আপ কো তো ইঁহা নহী আনা চাহিয়ে, আপকো তো অভী ওঙ্কাকারেশ্বর মে যানা চাহিয়ে’। কিছুই বুঝতে পারছি না আমি। আবার সেই একই কথার পুনরাবৃত্তি করি। এইবার সেই চোখের দৃষ্টিতে আগুন দেখলাম। ‘ওয়াপস চলে যাও, ইয়ে যমলোক হ্যায়’। তারপর আমার দিক থেকে দৃষ্টি ফেরালেন আমার স্বামীর দিকে। ‘ইস লেড়কী কো কিঁউ লেকে আয়ে হো ইধার?’, আমি যেন অন্য একটা কিছুর ধারণা করতে পারছি। আমার স্বামীর তো একেবারেই বস্তুনিষ্ঠ প্রাণ। তার কাছে এই সব কথার একটাই অর্থ, ‘পাগল’। আমি কিছুতেই বোঝাতে পারছি না যে, আমরা শুধুই ভ্রমণে বেরিয়েছি। স্বর্গলোক, যমলোক কোনটাই আমাদের ধারণার মধ্যে নেই। অগত্যা, আমরা চুপ করেই থাকি। খানিক পরে আবার বলে ওঠেন, ‘ওয়াপস যাও’। আমি মারিয়া হয়ে বলতে থাকি। ‘আমরা বেড়াতে এসেছি, উত্তরকাশীতে নচিকেতা তালের নাম শুনে আমরা এসেছি। আমরা কলকাতা থেকেই আসছি। প্রায় নরকলোক থেকে’। কি বুঝলেন কে জানে, আমার ডান হাতটাকে চেপে ধরলেন খপ করে। ‘চলো মেরে সাথ’, গলার স্বরটা একটু যেন নরম হলো। আমরা চুপচাপ ওনার পিছন পিছন হাঁটতে লাগলাম। অবশ্য, আমার একটা হাত তিনি এমন চেপে ধরে আছেন যে আমার কোন উপায়ও ছিল না।  নিয়ে গেলেন সেই ছাউনিতে। দূর থকে ভাল বোঝা যায়নি। বেশ বড়সড় সাধুর কুঠির। চারপাশ ঘেরা। মাটির লেপনে এক সুন্দর পরিবেশ। বেশ অনেকটা জায়গা নিয়ে এক হোমকুন্ড। ভিতরে ধিকি ধিকি আগুন জ্বলছে। একটা বই রাখা রয়েছে, আধখোলা। হোমকুন্ড ঘিরে সেই সাধুর সংসার। নির্দিষ্ট বসার জায়গা, বড় বড় দুটো চিমটে। আমাদের সেইখানে বসালেন। কাকে যেন ডাক দিলেন, আটা মেখে আনতে বললেন। আমার তখন ক্ষিদেও পেয়েছে। আমি ভাবছি আমাদের খাওয়াবেন বুঝি। হাসি হাসি মুখ করে আমার স্বামীর দিকে তাকালাম। ওরে বাবা, কি গম্ভীর হয়ে আছে। তারপর সেই সাধুবাবা কথা শুরু করলেন। প্রসঙ্গ নচিকেতা। কে ছিলেন এই নচিকেতা? বলতে লাগলেন তিনি। সেই সুরেলা কথনে ধীরে ধীরে চারপাশ তপবনের স্নিগ্ধতায় ভরে গেল। তার পাশে রাখা আধখোলা বইখানি নচিকেতা পুরাণ।

নচিকেতা উদ্দালক ঋষির পুত্র। পিতা তার একবার রেগে গিয়ে তাকে অভিশাপ দেন, নচিকেতার যেন যমদর্শন  হয়। নচিকেতা যমলোকে পৌঁছান। কিন্তু যমরাজ তখন যমলোকে অনুপস্থিত। তিনদিন পর ফিরে দেখেন এক সৌম্যকান্তি ব্রাহ্মণ তাঁর জন্য অপেক্ষায়। তিনি নচিকেতার প্রতি প্রসন্ন হয়ে তিনটি বর দিতে চাইলেন।

এক সৌম্যদর্শন মানুষ এক পিতলের থালায় আটা মেখে নিয়ে এসেছেন। ‘অব লিট্টি বানাও। আজ সব লোগ ইঁয়হ প্রসাদ পায়েঙ্গে’। আমার আটা দেখে যত আনন্দ হয়েছিল হটাৎ সব আনন্দ কোথায় উড়ে গেল। তাকিয়ে দেখি, কথাগুলো আমার উদ্দেশ্যেই বলা হলো। আমি লিট্টি বানাতে জানিনা। তিনি ভারী কৌতুক বোধ করলেন। ‘কই বাত নহী, হামলোগ মিলকে বনায়েঙ্গে’। আটার লেচি কেটে তিনি আমার হাতে দিতে লাগলেন। বললেন সেই লেচিগুলো হোমকুন্ডের আগুনে ফেলতে। আমার তো খুব মজা লাগছে। আমি তাই করতে লাগলাম। দেখি, সেই লম্বা চিমটি দিয়ে তিনি আটার গোল্লাগুলোকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দিচ্ছেন। সেই হোমকুণ্ডের ভিতর থেকে কি অসাধারণ এক গন্ধ বেরিয়ে আসছে। লিট্টিগুলো একটা একটা করে থালায় তুলে রাখলেন। তারপর নিজেই সেগুলোকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিলেন। আমায় ঘি আর চিনি দেওয়া হলো। সব দিয়ে আমি একটা কি যেন তৈরি করলাম। তারপর সবাইকে পরিবেশন করলাম। একসাথে বসে সবাই খেলাম। কি যে এক অনুভূতি হচ্ছিল বোঝাতে পারবো না। এক তপোবনের ছায়ায়, যোগীর কুঠিয়ায় তপস্বীর গাথা শুনতে শুনতে আমার মন হিমালয়ের প্রতি কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠল। খাওয়ার শেষে তিনি আরও আটা মাখতে বলে আমাদের নিয়ে জঙ্গলের আরেক দিকে হাঁটতে লাগলেন। আমার মোহাবিস্টের মতো চলেছি। খানিক  চলার পর দূর থেকে এক গুহামুখ দেখালেন। ঐখানেই নচিকেতা যমরাজের জন্য তপস্যা করেছিলেন। সেই তপস্যায় প্রসন্ন হয়ে যমরাজ নচিকেতার কাছে মৃত্যুলোকের রহস্য ব্যাখ্যা করেছিলেন। এক ঘোরের মধ্যে সত্যি সত্যি যেন সেই সময় পৌছে গেছি। কতক্ষন সেখানে কাটিয়ে এবার ফেরার পথ্ ধরলাম। কুঠিয়ায় ফিরে দেখি, এক থালা আটামাখা  রাখা রয়েছে। সেই ঋষি বললেন, এই নচিকেতা তালে বিষ্ণু মৎস্য অবতাররূপে অধিষ্ঠিত আছেন। সেই আটার থালা এক হাতে নিয়ে অন্য হাতে আমার হাত ধরে নিয়ে গেলেন সেই জলাশয়ের পাশে। আমাকে বললেন ছোট ছোট আটার গুলি জলে মধ্যে ছুঁড়ে দিতে। ওমা, কত কত মাছ কোথা থেকে ছুটে এলো। সাধুবাবার দিকে তাকিয়ে দেখি কি এক অপার্থিব আনন্দে মুখখানা তাঁর উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। সেই আনন্দচ্ছটা কতকটা আমার প্রাণেও ভরে নিলাম। এবার ফিরতে হবে। তাঁকে বললাম। মুখের ভাবে কিছুই বুঝলাম না।

 অনেক আশীর্বাদ করলেন। সারা জীবনের সর্বকর্মে আমার সফলতা কামনা করলেন। ওঙ্কারেশ্বরে যাবার কথা মনে করালেন। তারপর হাসিমুখে বিদায় দিলেন। মনটা হটাৎ ভারী হয়ে এল। ফেরার জন্য পা আর উঠতে চাইছে না। আমার সমস্ত জীবন সম্পূর্ণ সমর্পণ করলাম সেই মহাত্মার পায়ে। ‘ওঙ্কারেশ্বরজীর সাথে দেখা কোরো, বুঝলে?’, চোখের জল বাধা মানছে না কিছুতেই। হাতজোড় করি। হাসিমুখে আমার মাথায় হাত দিলেন। আরও বললেন, ‘কোন দিন এখানে আসবে না। মনে রেখো এটা যমলোক’।

কেন বারবার ওঙ্কারেশ্বরের কথা বললেন?

1 টি মন্তব্য:

কবিতা ৮ ।

 সপ্তসিন্ধু পার করে লখিন্দর ফেরে ঘরে।সাথে করে  বিবিধ রতন। শঙ্খ বাজে, উলু দেয় এয়োতি, পুরজন। বাপ তার, চন্দ্র সওদাগর। লখার সাফল্যে মুখে তার  গো...