শুক্রবার, ১৪ আগস্ট, ২০২০

এক মায়ের কথা !

 

আজ আমি জাহাজে চড়েছি। হাঁ, সত্যি। সত্যিকারের জাহাজ। ছবিতে যেমন দেখি। বিরাট বড় জাহাজ। যাব পোর্ট ব্লেয়ার থেকে ডিগলিপুর। এবার ঠিক করেছি, গাড়িতে নয়. জাহাজে, জলপথে পৌঁছব ডিগলিপুর। আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের উত্তরতম বিন্দু, যেখানে বসতি আছে, আছে বন্দর।

হাঁ, যে কথা বলছিলাম। জাহাজে উঠব। আটটার মধ্যে হাড্ডো জাহাজঘাটায় উপস্থিত হলাম। রাত নটায় জাহাজ ছাড়বে। একপ্রস্থ টিকিট পরীক্ষার পর জাহাজঘাটায় প্রবেশের ছাড়পত্র পাওয়া গেল। সাড়ে আটটায় জেটিতে পৌঁছে দেখি সেই বিরাট জলযান আলোয় আলোকিত হয়ে আমাদের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে। দুধ সাদা শরীর তার। সেই আলো শরীর বেয়ে পিছলে যাচ্ছে। আমার জীবনে প্রথম জাহাজে চড়া। ধীরে ধীরে এগিয়ে চলি। প্রবেশপথের মুখে টিকিট পরীক্ষক। ছবিতে যেমন দেখি সেই রকম সাদা জামা পরা। টিকিট পরীক্ষা করে আমায় ছাড়পত্র দিলেন। আমি প্রথম, আমার জীবনে প্রথমবার, জাহাজে পা রাখলাম। বিরাট হলঘর। সারি সারি মালপত্র রাখার খাঁচা। আমার লটবহরের লট-টাকে সেখানে রেখে বহর তিনটে হাতে নিয়ে আমি সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলাম। সিঁড়ি দিয়ে উঠে সামনে দেখা লোকটিকে জিজ্ঞাসা করলাম আমার আস্তানার কথা। টিকিট দেখে বলল, আরও উপরে উঠে যান, সামনে ডাইনিং হল, ওর ভিতর দিয়ে বাঁ দিকে যাবেন। তারপর একটা সিঁড়ি আছে। একদম উপরে উঠে যাবেন। ওরে বাবা! এত সেই সুকুমার রায়ের “ঠিকানা” কবিতা। যাই হোক, কি আর করা, আবার উঠতে লাগলাম। পৌঁছলাম অবশেষে। সুন্দর ব্যবস্থা। দুটো সাদা বিছানা। একটা কাঁচ-লাগানো জানালাও আছে। সেখান দিয়ে বন্দরের আলো দেখা যাচ্ছে। সহযাত্রী কেউ নেই। জিনিসপত্র রেখে বাইরে বেরোই। চেয়ার নিয়ে বসি।

ছোটবেলায় রূপকথায় পড়েছিলাম রাজপুত্র সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে রাজকন্যাকে উদ্ধার করতে যেত। কিন্তু তখনকার রাজাদের নাকি জাহাজ ছিল না, তাই ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমীর পিঠে যেত। আমার তখন মনে হতো আমিও সমুদ্র পেরিয়ে যাব। আর ব্যাঙ্গমাকে যদি না পাই তাহলে জাহাজে চড়ে সাগর পেরোব। কারণ, ব্যাঙ্গমাকে খোঁজা সে এক হাঙ্গামার ব্যাপার। রাত্রিবেলায় অন্ধকার বনের ভিতর যেতে হয়। তারপর গাছের তলায় রাত কাটাতে হয়। তারপর দৈববশে যদি সেই গাছের ওপর ব্যাঙ্গমার বাসা থাকে তবেই তার সাথে যোগাযোগ হবে। তার থেকে আমার জাহাজই ভাল।

সেই স্বপ্ন আমার কাছে ধরা দিয়েছে আজ। আর একটু পরেই জাহাজ ছাড়বে। ঐ যে ভোঁ বাজলো। পারের দিকে তাকিয়ে আছি। জাহাজ আস্তে আস্তে এগিয়ে চলেছে। ধীরে ধীরে ঘাটের আলোগুলো বিন্দুতে রূপান্তরিত হলো। ঘড়িতে নটা বেজে আঠারো মিনিট। সমুদ্রের হাওয়ায় শীতের আমেজ। কেবিনের দিকে পা বাড়াই।

ঘরে ঢুকে দেখি কার একটা ব্যাগ রাখা রয়েছে। ভাবি বুঝি অন্য কারো ঘরে ঢুকে পড়লাম। “ম্যাডাম, আমি কি আজ রাত এই ঘরে থাকতে পারি? আপনার যদি আপত্তি না হয় তো।” তাকিয়ে দেখি এক ভদ্রলোক আমার পিছনে দাঁড়িয়ে আছেন। সঙ্গে দুজন দেহরক্ষী। তাদের মধ্যে একজন সবিনয়ে বলতে লাগলো তাদের সাহেবকে হঠাৎ যেতে হচ্ছে। তাই বাধ্য হয়েই তিনি ইত্যাদি ইত্যাদি।

আমি আর কি করি। অগত্যা ‘তাহলে থাকুন’ বলে জিনিসপত্র সরিয়ে রাখি। ভদ্রলোক অতীব ভদ্রলোক। নিজেই পরিচয় করলেন। জানা গেল তিনি ভারতীয় নৌসেনার পাইলট। বাধ্যতামূলক স্বাস্থ্য পরীক্ষার পর তিনি কর্মস্থানে ফিরছেন।

ভোঁ—উঠে   পড়লাম। মায়াবন্দরের যাত্রী নামানোর সময় হয়ে গেছে। সমুদ্রের উপরে সূর্যোদয় হলো। জাহাজ আবার ঘাট ছাড়ল। আরেক ঘাটের উদ্দেশ্যে। আমি আবার ঘরে ফিরলাম। পাইলট সাহেব ততক্ষণে উঠে পড়েছেন। ‘গুড মর্নিং’ বললেন। তারপর আমাকে জাহাজ ঘুরিয়ে দেখাবেন বললেন। আমার তখন আনন্দ দেখে কে! পিছন পিছন চললাম। প্রথম নিয়ে গেলেন ডেকে। প্রতিটা যন্ত্র, মাস্তুল—তার ওপরের আলো। দড়ি, লাইফ-জ্যাকেট, লাইফ-বোট কোথায় থাকে। কিভাবে ব্যবহার করতে আপতকালীন সময়ে, সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বলতে লাগলেন। তারপর নিয়ে গেলেন জাহাজের প্রাণকেন্দ্রে। যেখান থেকে জাহাজ চালনা করা হয়। কম্পাস, প্রাচীনকাল থেকে নাবিকরা নৌচালনার সময় যে পদ্ধতি ব্যবহার করতেন, এখনও সেই মূল নিয়ম মেনেই জাহাজ চালনা করতে হয়। যন্ত্রপাতি অত্যাধুনিক, কম্পাস অত্যাধুনিক, কিন্তু বিদ্যুত বিভ্রাট হলে পুরোনো কম্পাসই ভরসা। কাপ্তেন সাহেব এসে আলাপ করলেন। উনি সব ঘুরিয়ে দেখানোর পর চা খাওয়ালেন। সেই সব করতেই সময় পার। দূর থেকে আমার ঘাট দেখা গেল। সবুজের, গাঢ় সবুজের আস্তরণের মাঝে একটুখানি ফাঁকা। ওই খানেই তো আমি নামব।

‘দিদি, এদিকে’—বিশুদ্ধ বাংলায় ডাক শুনে পিছন ফিরে দেখি ‘দীপঙ্কর’, আমাকে নিতে এসেছে।

পৌঁছলাম গিয়ে আমার চারদিনের আস্তানায়। এবার কেন এসেছি বলি। দূর, বহুদূর পৃথিবীর আরেক প্রান্ত থেকে কিছু অতিথি এই সময় আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের কিছু নির্জন সমুদ্রতটে আসে। কেন আসে? মা হবে বলে। হাঁ, ঠিক ধরেছেন। কিছু বিরল প্রজাতির সামুদ্রিক কচ্ছপ প্রতি বছর হাজার হাজার মাইল পার হয়ে এই ভারতবর্ষের মাটিতে ডিম পাড়তে আসে। মূলত পাঁচটি প্রজাতি। গ্রিন টারটেল, হক্সবিল, লেদারব্যাক, অলিভ-রিডলে এবং লগারহেড। তারা আসে, ডিম পাড়ে এবং ফিরে যায়। তারা জানে না তাদের বাচ্ছারা সবাই ফিরতে পারবে কিনা। কিভাবে পথ চিনে তারা তাদের মা-বাবার কাছে ফিরে যাবে। অদ্ভুত এক প্রাকৃতিক নিয়মের ক্রীড়নক তারা। প্রকৃতি কার জন্য কি নির্ধারন করেছে কেউ জানে না। আমি এসেছি সেই কচ্ছপ-মায়েদের সাথে দেখা করতে।

সমস্ত সমুদ্রতটে এখন জরুরী অবস্থা চলছে। পর্যটকরা রাত্রে বিশেষ কিছু সমুদ্রতটে  যেতে পারবেন না। কারণ, ভয় পেলে সেই বিশেষ সময়টুকুর ব্যবহার না করতে পারলে সেই আসন্ন প্রসবা কচ্ছপ-মা অসহায় হয়ে পড়বে। বিশেষ সময় বলছি তার কারণ আছে। অনেকগুলো শর্তের ওপর এই প্রসব করা নির্ভর করছে। দিনের বেলায় এই ঘটনা ঘটেই না। ঘটলেও তা প্রায় বিরল ঘটনা বলে গণ্য হয়। রাত্রিবেলা সমুদ্রে ভরা জোয়ারের সময় এই মা কচ্ছপরা জল ছেড়ে বলিয়াড়িতে উঠে আসে। তারপর নিজে পছন্দ মত জায়গায় বালি খুঁড়ে তার ভিতরে ডিম পাড়ে। এক সাথে প্রায় একশো দেড়শো ডিম পাড়ে।তারপর আবার বালি চাপা দিয়ে দেয়। তারপর ধীরে ধীরে আবার সমুদ্রে ফিরে যায়। যাবার সময় আর পিছন ফিরেও দেখে না। প্রকৃতির কি অদ্ভুত নিয়ম। অনাগত সন্তান তার, অজানা পরিস্থিতিতে, নিষ্ঠুর সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে তার মায়ের সাথে দেখা করবে বলে আবার সমুদ্রগামী হবে। এই সমস্ত ঘটনা ঘটতে মাত্র একঘন্টা থেকে দেড় ঘণ্টা সময় লাগে। ভরা জোয়ারেই মাকে আবার সমুদ্র ফিরে যেতে হবে।

এর পরের ঘটনার সাক্ষী হতে আমার এইবারের আন্দামান যাত্রা। সময় আর কাটে না। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হলো। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত। বিকেলে একবার ঘুরে এসেছি সমুদ্রের ধার থেকে। সমুদ্রও শান্ত। শুধু হাওয়ায় হাওয়ায় ফিসফাস। তারা আসছে, তারা আসছে। শুনে ছিলাম এই প্রজাতির কচ্ছপরা যেখানে জন্মগ্রহণ করে তার নিজেদের প্রসবের সময় সেখানেই ফিরে আসে। এটাই পরম্পরা। আবহমানকাল এই নিয়মের অনুসারী তারা। প্রসবের পর কাঁদতে কাঁদতে মায়েরা ফিরে যায়। ভাবতে ভাবতেই মন ভারী হয়ে ওঠে। গলার কাছে কি একটা দলা যেন আটকে যায়। আপনিই চোখ আমার জলে ভরে ওঠে।

মূলত, অস্ট্রেলিয়া থেকে এই কচ্ছপরা আসে। শিশু জন্মানোর পর বাচ্ছাদের খোলের উপর বনদপ্তরের কর্মীরা অস্ট্রেলিয়ার ছাপ লাগিয়ে দেয়। যে কচ্ছপরা আসে তাদের পিঠের খোলের উপর অস্ট্রেলিয়ার ছাপই এ পর্যন্ত পাওয়া গেছে।

রাত সাড়ে নটা নাগাদ আমি তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়লাম। ঈশ্বরকে স্মরণ করলাম। এমন এক মায়ের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি যে মা নিশ্চিন্তে তার সন্তানের দায়িত্ব প্রকৃতি মায়ের হাতে ছেড়ে দিতে পারে।

সমুদ্রের ধারে হাওয়া বইছে। আকাশ তারায় ভরা। জোয়ার এসে গেছে। জলের কুলু কুলু ঢেউ এখন ছলাৎছল বলছে। বনকর্মীরা সবাই সমুদ্রতটে ছড়িয়ে পড়েছে। মোবাইলের টর্চ জ্বেলে এদিক ওদিক তাকাচ্ছি। সময় আর কাটে না। আসবে তো? তার সাথে দেখা হবে তো আমার? পৌনে এগারটার সময় সবাইকে পিছনে সরে যেতে বলা হলো। এসেছে, সে এসেছে। দুটো মোবাইলের টর্চের আলোর বিন্দু তার পাশ দিয়ে চলেছে। ধীরে ধীরে সে এগিয়ে আসছে। অত পথ পাড়ি দিয়ে সে এসেছে শুধু তার সন্তানের জন্ম দিতে। আসন্ন প্রসবার প্রসব যন্ত্রনাও শুরু হয়েছে হয়তো। এক সময় সে থামে। আমি দম বন্ধ করে বসে আছি। এক জাগতিক সত্যের অপেক্ষায়। অবশেষে এল সেই মুহূর্ত। সে প্রথম ডিম দুটো প্রসব করল। হাঁ, এক সাথে দুটো করে ডিম। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে আমার। আমি প্রকৃতির এই চরম রহস্যের সাক্ষী হয়ে থাকলাম। বন দপ্তরের কর্মীরা পিছন দিক থেকে বালি সরিয়ে দিচ্ছেন। আমি ধীরে ধীরে মায়ের মুখের ঊপর হালকা আলো ফেললাম। মায়ের মুখ গর্বে ভরে উঠেছে। প্রথম মাতৃত্বের স্বাদ আস্বাদনের আনন্দে সে মুখ আলোকিত। তার দু-চোখের কোণে ঐ কি চকচক করছে? ধীরে তার পিঠের ওপর হাতটা রাখলাম। মাথাটা উপর দিকে তুলে দুবার সে ঢোঁক গিলল। গলা থেকে তার কি এক শব্দ হলো। হয়তো ঈশ্বরের কাছে সন্তানসকলের মঙ্গল কামনা করলো। হয়তো সদ্যজাতককে ছেড়ে যাওয়ার অসহ্য ব্যথা জানালো অথবা ঈশ্বরীয় নিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করল। জানিনা, তার চোখের জল আমার মাতৃসত্বাকেও ছুঁয়ে গেল। খোলা আকাশের নীচে সেই মায়ের সাথে আমিও কাঁদতে লাগলাম। তারপর আমার অবচেতনায় যেন শুনতে পেলাম, ‘আমি মা হয়েছি’।

তার ডিম পাড়া শেষ হয়ে গেছে। সে ফিরে যাচ্ছে। না, একবারও পিছন ফিরল না সে। ধীরে ধীরে প্রসবের ক্লান্তিকে সাথী করে, মা হবার গর্বে, আনন্দে তার ভাবীকালের সন্তানকে প্রকৃতি মায়ের হাতে সঁপে দিয়ে সে এগিয়ে চলেছে সাগরের দিকে। যে পথ দিয়ে তার সন্তানেরা তার যাত্রা সম্পূর্ণ করবে।

1 টি মন্তব্য:

কবিতা ৮ ।

 সপ্তসিন্ধু পার করে লখিন্দর ফেরে ঘরে।সাথে করে  বিবিধ রতন। শঙ্খ বাজে, উলু দেয় এয়োতি, পুরজন। বাপ তার, চন্দ্র সওদাগর। লখার সাফল্যে মুখে তার  গো...