বৃহস্পতিবার, ২৭ আগস্ট, ২০২০

সম্পর্কের অন্তরালে

"ম্যাডাম, আমরা তাহলে আজ উঠি, যদি আরও কিছু মনে পড়ে তাহলে ফোন করবেন। এত ভেঙে পড়বেন না।" রমা মাথা নাড়ে। পুলিশ অফিসার চলে গেলে দরজাটা বন্ধ করে আবার চেয়ারে বসে পড়ে। কি যে দুশ্চিন্তা, কিন্তু ভেবে কোনো কুল কিনারা পাওয়া যাচ্ছে না। তবে একটা কথা জলের মতো পরিষ্কার করে জানা গেছে; তার জীবনের এই বিপর্যয়ের মূলে তার মা, হ্যাঁ, নিজের মা। গ্রেপ্তারের কথা পুলিশ বারবার বললেও সে সায় দিতে পারেনি, তার মূল্যবোধ তাকে পিছনে টেনে রেখেছে। ভাবছে আর ভাবছে, কি করবে সে এখন? এ লজ্জার কথা কাকে বলবে, কে বিশ্বাস করবে? আত্মীয় স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী সবার মধ্যেই একটা ফিসফাস, তাকানোর মধ্যেও একটা অস্বাভাবিক ভাব। অনেকক্ষণ পর চোখ মুছে জানলার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। গেটটা দেখা যাচ্ছে। রোজ সকালে বাবু স্কুলে যাওয়ার সময় ওখান থেকেই বলতো, "মা, আসি", বারান্দা থেকে সে হাত নাড়ত, বলতো, "সাবধানে যেয়ো"। নিয়মমাফিক এই ঘটনারই পুনরাবৃত্তি হতো রোজ। তবে, ওইদিন কি হয়েছিল? বাবু স্কুলে বেরিয়ে যাওয়ার পর রমা ছোট ছেলেকে ক্রেশে দিয়ে রোজকার মতোই অফিসে গিয়েছিল। ফেরার পথে রোজকার মতোই ছেলেকে নিয়ে বাড়ি ফিরেছিল। বাড়ি ফিরে হাত পা ধুয়ে চা বসায়। মায়ের হাতে চায়ের কাপটা দিয়ে বাবুর কথা জিজ্ঞাসা করে। মায়ের কাছে জানতে পারে যে বাড়ির পাশের মাঠের মেলায় গেছে। কথায় কথায় আরও কিছু সময় কেটে যায়। আমি আসছি, রমা বলে মা জিজ্ঞাসা করে, কোথায় যাচ্ছ? সে বলে, দেখি বাবুকে একবার। মা বলে ওঠে, তোমায় একটা কথা বলার ছিল, বাবু বাড়ি থেকে চলে গেছে। কি, কি বললে? রমা চিৎকার করে ওঠে। তুমি তো এতক্ষন বললে না রমাকে থামিয়ে দিয়ে তিনি বলতে থাকেন, তোমাদের জন্য একটা চিঠি লিখে রেখে গেছে। ভেবেছিলাম তোমাদের খাওয়া হয়ে গেলে বলবো। কি নির্বিকার ভাবে বলে যাচ্ছেন তিনি, রমার মাথায় কিছুই ঢুকছে না সে আর সহ্য করতে পারে না, চিৎকার করে বলে, “তুমি মিথ্যা কথা বলছো" সেই চিৎকারে বাবা ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন সব শুনে তার মায়ের দিকে তাকিয়ে বলেন, সেই সর্বনাশটা করলে!" বলতে বলতে তিনি হু হু করে কেঁদে ফেলেন আশি বছর বয়স তাঁর, এই বৃদ্ধ বয়সে এই শোক তিনি কি ভাবে সহ্য করবেন? কিন্তু রমার অতো কথা ভাবার সময় কোথায় এখন, সে মাকে চেপে ধরে, সত্যি কথা বলো,বাবু কোথায়? না, কোনো কথাই সে বলাতে পারে না। এর মধ্যে তার স্বামী ফিরে আসে। আর নিজেকে সে ধরে রাখতে পারে না, সব কথা বলতে গিয়ে সে কান্নায় ভেঙে পড়ে। সব শুনে তিনি রমাকে সাথে নিয়ে থানায় যান। সব ঘটনা লিখিতভাবে জমা করে তারা বাড়ি ফিরে আসে। তারপর পরিচিত সব মানুষ জনের বাড়িতে ফোন করে। কোথাও থেকেই কোনো খবর তারা পায় না। একা বসে বসে ভাবতে থাকে কোথায় আছে ছেলেটা, কি খাচ্ছে, ভাবতে ভাবতেই  হু হু করে কেঁদে ওঠে সে। উফ, কি কুক্ষণে বাবার কথায় রাজি হয়েছিল নিজের ছোটবেলাটা আবার মনের আয়নায় ফুটে উঠতে থাকে। ছোট থেকেই সে কোনোদিন মায়ের আদর পায় নি। ষাটের দশকের চাকরি করা আধুনিক মহিলা, বামপন্থী আদর্শে বিশ্বাসী, কিন্তু প্রথম সন্তান মেয়ে? না, তিনি মন থেকে মানতে পারেন নি। বাবার দুচোখের মনি ছিল সে। দাদু ঠাকুমার আদরের দুলালী। এই আদরের বহিঃপ্রকাশ তাঁর চোখে বাড়াবাড়ি মনে হতো। তার স্বাভাবিক  জীবনের  বেড়ে ওঠার পথে পদে পদে অন্তরায় সৃষ্টি করেছেন, অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছেন এরপর তার একটি বোন জন্মায়। তারপর তার মায়ের ঔদাসীন্য আরও বেড়ে যায়। দুটি বোন একসাথে বড় হয়ে উঠছিল। তখন এইসব ঘটনা সমাজে গুরুত্বই পেতো না। মায়েরা সবসময় সন্তানের ভালো চান, তাঁরা কোনো অন্যায় করতে পারেন না, যা করেন সব সন্তানের ভালোর জন্য, এই সব চিন্তা ভাবনাই সমাজে মান্যতা পেতো। রমা পারিবারিক মূল্যবোধকে জীবনের সার মেনে মুখ বুজে সব সহ্য করে এসেছে। আর সেজন্যই বাবা যখন তাঁর অবসর জীবন বড়ো মেয়ের কাছে কাটাবেন বলে মনস্থির করেন, তখন রমা যে তার সাথে মায়ের সাথে সম্পর্কের কথা ভাবে নি তা নয়, কিন্তু স্নেহময় বাবাকে সব সময়ের জন্য কাছে পাওয়ার, সেবা করার সুযোগটুকু পেয়ে সে বাকিটা মানিয়ে নেবে বলেই মনস্থির করে,

প্রথম কয়েক মাস আনন্দে কেটে যায় দুই নাতিকে সঙ্গে পেয়ে বাবাও খুব আনন্দে আছেন। মা মায়ের মতো থাকেন। একদিন রাতে খেতে বসে মা সেই পুরোনো দিনের কথায় ফিরে যান। তাঁর চাকুরী জীবনের কথায়, অপূর্ণ থাকা ইচ্ছার আলোচনায়। চাকরি করার সাথে সাথে তিনি বামপন্থী সরকারি ইউনিয়নের নেত্রীও ছিলেন। দীর্ঘ দিন রাজনৈতিক ক্ষমতার কাছা কাছি থাকার জন্য সাধারণ আশাগুলোতেও রাজনৈতিক ছোঁয়া লেগেছিল তাঁর। তিনি চেয়ে ছিলেন যে রমা সেই বামপন্থী দলের সর্বক্ষণের কর্মী  হিসেবে সেই দলে যোগদান করুক। কিন্তু কোন কারণে সেটা হয়ে ওঠেনি । কথাচ্ছলে বল্লেও তাঁর উষ্মাটুকু তিনি পারেন না লুকোতে। সেই কবেকার একটা সাধারণ ঘটনাকে তিনি তাঁর ব্যক্তিগত ব্যর্থতা হিসেবে এত বছর ধরে চিহ্নিত করে রেখেছেন, রমা ভাবে, কিন্তু আশ্চর্য হয় না, কারণ সে তার মাকে চেনে। সেই সূত্রপাত। তারপর থেকে মাঝে মধ্যেই তিনি নিজের উষ্মা প্রকাশ করেন। বাবার সাথে ছোট খাটো ব্যাপারে অশান্তি করেন। রমা বোঝায়। এই ভাবে দিন কাটতে থাকে। একদিন অফিসে বাবুর ফোন আসে, কান্না-ভেজা গলায় সে বলতে থাকে যে দিদিমা তার সামনে ছোট ভাইকে মেরেছে

অফিস থেকে ওরা ফিরতেই তিনি বলতে থাকেন ছোটছেলের দুস্টুমির কথা। বাবু বলে দিদিমার খারাপ ব্যবহারের কথা। রমাদের অনুপস্থিতিতে ছোট ভাইকে উত্যক্ত করার কথা। রাতে মায়ের কাছে শুয়ে বাবু জানায় সারাদিন বাড়িতে নানা অচেনা মানুষের আসার কথা। মা কে জিজ্ঞাসা করলে বলেন অফিসের  লোক, দেখা করতে এসেছিল। রমার স্বামীর বদলির চাকরি, এমতাবস্থায় তারা ঠিক করে যে দুই ছেলেকে আবাসিক স্কুলে ভর্তি করবে। এত অশান্তি, বাবা একদিন বললেন বৃদ্ধাশ্রমে চলে যাবেন। রমা কেঁদেই অস্থির হলো। এই বয়সে কিভাবে পরিবার থেকে দূরে থাকবে? এর মধ্যেই দুই ছেলেকে তারা দার্জিলিংয়ের বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি করে। কিছুদিন বাড়িতে শ্মশানের শান্তি বিরাজ করে। কিন্তু কিছুতেই সে মায়ের লাগাতার অন্যায়ের প্রতিবাদ বাবার সামনে মুখ ফুটে করে উঠতে পারেনি। আত্মীয় স্বজনের কথা ভেবে। তিন চার মাস যে না যেতেই বড়ো ছেলে খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে। জন্ডিস ধরা পড়ে তার। বাধ্য হয়ে ওকে বাড়ি ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করতে হয়। বাড়ির কাছের এক স্কুলে ওকে ভর্তি করে । মোবাইলটা বাজছে। ফোনটা ধরে সে। ওপার থেকে এক আত্মীয়ের গলা ভেসে আসে। ওরা আজ আসছে। রমা যেন মনে একটু জোর পায়। কিন্তু এ কি শুনছে সে? তারা বলতে এসেছে যে রমার মাকে যেন পুলিশ জ্বালাতন না করে; রমা প্রতিবাদ করে, এটা জ্বালাতন নয়, ওনার উপস্থিতিতে এই ঘটনা ঘটেছে। পুলিশকে সহযোগিতা করা উচিত এখন। বাবার দিকে তাকায় রমা, দুচোখ দিয়ে জল পড়ছে তার। আবার একবার বাবার ভরসার হাতটা মাথার ওপর অনুভব করে সে। চোয়াল শক্ত করে সে বলে চলে....তা নাহলে মা প্রথম দিন থেকে মিথ্যে বলছেন কেন? মাথাটা ক্রমশ পরিস্কার হয়ে আসে তার, স্পষ্ট ভাষায় সে মাকে বলে, সত্যি কথা তোমায় বলতেই হবে, নাহলে আমি  C.I.Dর কাছে যাবো।”

একটা কথা পরিষ্কার, আপনার মা সব জানেন", রমা চমকায় না, "শুধু বয়সের কারণে ওনাকে থানায় আনা যাচ্ছে না, থানায় আনা গেলেই উনি ব্রেক করতেন", "তাহলে তাই করুন" রমা বলে আমরাও তারই প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, কিন্তু আজ এক রাজনৈতিক নেতার থেকে ফোন এসেছে বুঝতেই তো পারছেন, আমরা সরকারি চাকরি করিথানায় বসে অসহায় রমা তার থেকেও বেশি অসহায় প্রশাসনিক আধিকারিকের দিকে তাকিয়ে থাকে। খানিক চুপ করে থেকে ওসি জিজ্ঞাসা করেন, “আচ্ছা, উনি কি আপনার নিজের মা, না মানে বলছিলাম যে নিজের মা হলে এই কাজটা করা ওনার পক্ষে করা সম্ভব হতো না কানের ভিতর দিয়ে কথাগুলো ছেঁড়া ছেঁড়া ভাবে প্রাণে গিয়ে লাগে।তার মানে স্থানীয় থানা আর কিছু করতে পারবে না। নমস্কার করে তারা থানা থেকে বেরিয়ে আসে। বাড়ি ফিরে আসার পথে সে উপলব্ধি করে যে মনের ভিতর  মায়ের সংজ্ঞাটা বদলে গেছে। আচ্ছা, কুমাতা কি সত্যিই হয়? যদিও এখন সমাজ অনেক বদলে গেছে। বর্তমান সমাজে কুমাতার উদাহরণ বিরল নয়। কুমাতাও  সমাজে এখন বিরল নয়। রাতে স্বামী স্ত্রী তে বসে ভাবে, এই ষড়যন্ত্রের হাত থেকে মুক্তির উপায় কি?

ঠিক সকাল দশ টায় C.I.D অফিসে পৌঁছায় তারা ছেলের হারিয়ে যাওয়ার বিবরণ লিপিবদ্ধ করে। আশায় বুক বাঁধে। এবার নিশ্চয়ই একটা ব্যবস্থা হবে। বাড়ি ফেরার পথে পিয়নের সাথে দেখা হয়। সে একটা রেজিষ্ট্রি চিঠি দিতে এসেছিল, বাড়ি বন্ধ থাকায় ফিরে যাচ্ছিল রমার নামেই চিঠি। মনের মধ্যে তোলপাড় হয়, কিসের চিঠি? মুক্তি পন নয়তো? তাড়াতাড়ি চিঠি খুলে দেখে আদালতের সমন। কী নোংরা খেলায় মেতে উঠেছেন উনি? রমার বিরুদ্ধে রমার বাবাকে দিয়ে কোর্টে মামলা করিয়েছেন, মিথ্যা অত্যাচারের নালিশ তার বিষয়বস্তু। ঘেন্নায় সারা শরীর  কেঁপে ওঠে তার, এত নীচে নেমেছেন উনি যে নিজের মা হিসাবে ভাবতেও ঘৃণা বোধ হচ্ছে। কি কুক্ষণে সে ওনাদের কাছে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, বিশ্বাস করেছিল চিঠিটা হাতে নিয়ে বাবার ঘরে যায়, তার পায়ের শব্দে বাবা ওর দিকে তাকান রমা সেই কাগজগুলো বাবার দিকে এগিয়ে দেয়। বাবা  পড়তে থাকেন, সে খাটের উপর বসে পড়ে

..... কিন্তু এই মামলা তো আমি করিনি, বাবা বলেন। তাহলে, তাহলে কি.......উফ, কি সাংঘাতিক ষড়যন্ত্র। বাবার বয়ানে বাবার সই জাল করে এই মামলা করা হয়েছে। এক অশীতিপর, অসহায় বাবা আর তার মেয়ে, দুজনে সেই নিস্তব্ধ ঘরে বসে আছে। বাবা ধীরে ধীরে তার মাথায় হাত রাখেন, বলেন "আমায় ক্ষমা করে দিও তোমরা, আমারই ভুল হয়েছিল। আমি তো তোমার মাকে চিনতাম, পুত্র সন্তান না জন্মাবার  ক্ষোভ তার ছিল ছেলেবেলা থেকেই তার সেই ক্ষোভের শিকার তুমি ছিলে। আমি সর্বদাই তোমার ব্যথা অনুভব করতাম। অনেক বুঝিয়েছি তাকেও। তিনি আমাকেও কোনোদিন ক্ষমা করেন নি। আমি এবং তুমি ওর কাছে সমান অপরাধী ছিলাম। সারা জীবন এই অকৃত অপরাধের ভার আমি বয়ে চলেছি। আমি ভেবেছিলাম শেষ জীবনে দুই নাতিকে নিয়ে তিনি খুশি থাকবেন। কিন্তু তার মনের বিকার যে এই পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে তা আমি ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি । পর ওর এই দুটো ঘটনা আমার চোখ খুলে দিয়েছে, আজ আমার কাছে সব জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেছে। আমার আর কিছু বলার নেই। তোমরা পারলে আমায় ক্ষমা করে দিও", বলতে বলতে তিনি শিশুর মতো হাউহাউ করে কাঁদতে থাকেন রমা চুপ করে বসে থাকে, সান্ত্বনার ভাষা হারিয়েছে সে, কি নারকীয় মানসিক অত্যাচার তিনি সহ্য করেছেন। আজ সহ্যের শেষ সীমায় এসে ভেঙে পড়েছেন একেবারে। সে ভাবতে থাকে কি কুটিলতার সাথে তার মা একটার পর একটা অপরাধ করে চলেছেন পাকা অপরাধীর মতো। একটা অপরাধকে ঢাকতে গিয়ে আরেকটা অপরাধ করছেন, কি সাঙ্ঘাতিক প্রতিশোধ স্পৃহায় সব বোধ হারিয়েছেন তিনি। উদ্দেশ্য শুধুমাত্র রমার ক্ষতি করা। তাঁর কাছে রমা সন্তান নয়, এক না চাওয়া  সামাজিক বাধ্যতা। কি চরম মানসিক বিকৃতি। তিনি নিজে যা পান নি রমা কেও তা পেতে দেবেন না। কি ভীষণ ষড়যন্ত্র করেছেন দিনের পর দিন। কেউ অবিশ্বাস করতে পারবেনা। এখন নিজেকে বাঁচাবার জন্য মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে  দিচ্ছেন। আমায় একটু জল দাও" সে বাবাকে জল এনে দেয় বাবা নিজেকে সামলে নিয়েছেন অনেকটা। কিন্তু বাবুকে তার তো খুঁজে বার করতেই হবে, তার সাথে এই মামলায় লড়তে হবে। কোথায়, কার কাছে যাবে সে, ভাবতে গিয়ে হঠাৎ তার মনে  পড়ে ব্যারিস্টার জেঠুর কথা ছোটবেলায় বাবার সাথে যেত। হাওড়ায় বাড়ি। নামকরা মানুষ, বাড়িটা খুঁজে পেতে অসুবিধা হয় না তার। নাম পরিচয় বলতেই চিনতে পারেন তিনি। সব কথা খুলে বলে রমা। শুনতে শুনতে  তিনি স্বগতক্তির মতো বলতে থাকেন, এত বছরেও স্বভাবের কোনো পরিবর্তন হলো না, বুঝলে, কর্মক্ষেত্রেও ওনার ওই স্বভাবের জন্য  সবাই এড়িয়েই চলতো, মানুষের ক্ষতি করতে ওনার হাত কোনো দিন কাঁপে নি। সরকারি চাকরি আর রাজনৈতিক ক্ষমতার জোরে যা খুশি করেছেন তিনি। কেউ কোনোদিন ওনার বিরুদ্ধে মুখ খুলতে সাহস পায় নি। তুমি বোধ হয় ওনার আজীবনের শেষ শিকার। সবাই এড়িয়ে গেলেও তুমি ওনার কাছ থেকে পালাতে পারবে না, কারণ তুমি ওনার সন্তান। আত্মীয়দের চোখে তিনি তোমায় অপরাধী বানিয়েছেন, এবার আইনের চোখেও তোমায় অপরাধী বানাবেন ওনার বয়সটাকে উনি ঢাল বানিয়েছেন। দীর্ঘদিন আমি ওনাকে খুব কাছ থেকে দেখেছি। মানসিক অত্যাচার করে উনি যত আনন্দ  পান, আর কিছুতে তিনি অত আনন্দ পান না" রমা ব্যাকুল হয়ে প্রশ্ন করে, তাহলে কি হবে?" আমি লড়ব এই মামলা.....রমা ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলে চোখ মোছ, কেঁদে কোনো লাভ নেই এ লড়াই লড়তেই হবে। তোমার জানা দরকার, তোমার বাবার ভালোমানুষির সুযোগ নিয়ে অফিসে অনেক হেনস্থা ওনাকেও করেছেন। কিন্তু কোনোদিন ভাবিনি ওনার বিরুদ্ধে মামলা লড়তে হবে। এত নীচে নামা ওনার পক্ষেই সম্ভব। আর এটাই বোধ হয় নিয়তি। সারা জীবন ধরে সবাইকে জব্দ করতে করতে আজ নিজের জালে নিজেই পড়েছেন। আদালতের ফাঁদে তোমায় ফেলতে গিয়ে নিজের কি সর্বনাশ ডেকে এনেছেন উনি জানেন না। ওনার অন্যায়ের বৃত্ত সম্পূর্ণ হয়েছে। তোমার এই কষ্ট আমি নিতে পারবো না, কিন্তু এই মামলা আমি লড়ব" নতুন ভরসায় বুক বেঁধে রমা বাড়ি ফিরে আসে

তার পরের ঘটনা সংক্ষিপ্ত। আদালতে মামলা ওঠে। বাদী পক্ষ বাবা, বিবাদী পক্ষ মেয়ে, এই মামলা বাবা করেন নি, এক তৃতীয়পক্ষের জালিয়াতিতে এই বিচিত্র মামলার উৎপত্তি এই তৃতীয় পক্ষ হলো বাবার অগ্নিসাক্ষী করে বিয়ে করা স্ত্রী আর মেয়েটির জন্মদাত্রী মা। বাবা লজ্জায় স্ত্রীর বিরুদ্ধে কোথাও অভিযোগ জানাতে পারেন নি, স্ত্রীর কৃতকর্মের দায় নিজের মাথায় নিয়ে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আছেন। বাবাকে নাস্তানাবুদ হতে দেখে সে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। কিন্তু এ যে কুরুক্ষেত্র, কোনো উপায় নেই। সওয়াল জবাবের শুনানিতে মাননীয় বিচারকের কিছু বুঝতে বাকি থাকে না। মাত্র দুই বছরের মধ্যেই এই মামলার নিষ্পত্তি হয়। আদালত অত্যন্ত রূঢ় ভাষায় বাদীপক্ষের নিন্দা করেন। মাননীয় আদালত এই মামলাকে গার্হস্থ্য হিংসার এক অন্যতম দৃষ্টান্ত হিসাবে চিহ্নিত করেন। সেই ভীষণ দিনে বাবা তাঁর বিবাহিত স্ত্রীর সকল কৃতকর্মের ফল মাথায় নিয়ে আদালত থেকে ফিরেছিলেন। তাঁর ন্যুব্জ দেহ আরও ঝুঁকে পড়েছিল। রমা পাথর হয়ে গিয়েছিল। সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে দেখেছিল সেই মহিলার আচরণ, যেন কিছুই হয় নি

আজ বাবার ছবির সামনে দাঁড়িয়ে কত কথা মনে পড়ে যায়। এক বিকৃত বুদ্ধি, অপরাধী মননের মানুষের সাথে দীর্ঘ দাম্পত্য জীবন কি বিভীষিকাময় ছিল তাঁর, কি ভীষণ যন্ত্রনা তিনি পেয়েছেন সারা জীবন ধরে। কিন্তু কি অসীম ধৈর্য্যের সাথে সেই অগ্নিকে সাক্ষী রেখে করা "যদিদং হৃদয়ং তব" মন্ত্রের সন্মান আমৃত্যু রক্ষা করে গেছেন। আজ তার বাবার চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকী।

শুক্রবার, ১৪ আগস্ট, ২০২০

এক মায়ের কথা !

 

আজ আমি জাহাজে চড়েছি। হাঁ, সত্যি। সত্যিকারের জাহাজ। ছবিতে যেমন দেখি। বিরাট বড় জাহাজ। যাব পোর্ট ব্লেয়ার থেকে ডিগলিপুর। এবার ঠিক করেছি, গাড়িতে নয়. জাহাজে, জলপথে পৌঁছব ডিগলিপুর। আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের উত্তরতম বিন্দু, যেখানে বসতি আছে, আছে বন্দর।

হাঁ, যে কথা বলছিলাম। জাহাজে উঠব। আটটার মধ্যে হাড্ডো জাহাজঘাটায় উপস্থিত হলাম। রাত নটায় জাহাজ ছাড়বে। একপ্রস্থ টিকিট পরীক্ষার পর জাহাজঘাটায় প্রবেশের ছাড়পত্র পাওয়া গেল। সাড়ে আটটায় জেটিতে পৌঁছে দেখি সেই বিরাট জলযান আলোয় আলোকিত হয়ে আমাদের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে। দুধ সাদা শরীর তার। সেই আলো শরীর বেয়ে পিছলে যাচ্ছে। আমার জীবনে প্রথম জাহাজে চড়া। ধীরে ধীরে এগিয়ে চলি। প্রবেশপথের মুখে টিকিট পরীক্ষক। ছবিতে যেমন দেখি সেই রকম সাদা জামা পরা। টিকিট পরীক্ষা করে আমায় ছাড়পত্র দিলেন। আমি প্রথম, আমার জীবনে প্রথমবার, জাহাজে পা রাখলাম। বিরাট হলঘর। সারি সারি মালপত্র রাখার খাঁচা। আমার লটবহরের লট-টাকে সেখানে রেখে বহর তিনটে হাতে নিয়ে আমি সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলাম। সিঁড়ি দিয়ে উঠে সামনে দেখা লোকটিকে জিজ্ঞাসা করলাম আমার আস্তানার কথা। টিকিট দেখে বলল, আরও উপরে উঠে যান, সামনে ডাইনিং হল, ওর ভিতর দিয়ে বাঁ দিকে যাবেন। তারপর একটা সিঁড়ি আছে। একদম উপরে উঠে যাবেন। ওরে বাবা! এত সেই সুকুমার রায়ের “ঠিকানা” কবিতা। যাই হোক, কি আর করা, আবার উঠতে লাগলাম। পৌঁছলাম অবশেষে। সুন্দর ব্যবস্থা। দুটো সাদা বিছানা। একটা কাঁচ-লাগানো জানালাও আছে। সেখান দিয়ে বন্দরের আলো দেখা যাচ্ছে। সহযাত্রী কেউ নেই। জিনিসপত্র রেখে বাইরে বেরোই। চেয়ার নিয়ে বসি।

ছোটবেলায় রূপকথায় পড়েছিলাম রাজপুত্র সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে রাজকন্যাকে উদ্ধার করতে যেত। কিন্তু তখনকার রাজাদের নাকি জাহাজ ছিল না, তাই ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমীর পিঠে যেত। আমার তখন মনে হতো আমিও সমুদ্র পেরিয়ে যাব। আর ব্যাঙ্গমাকে যদি না পাই তাহলে জাহাজে চড়ে সাগর পেরোব। কারণ, ব্যাঙ্গমাকে খোঁজা সে এক হাঙ্গামার ব্যাপার। রাত্রিবেলায় অন্ধকার বনের ভিতর যেতে হয়। তারপর গাছের তলায় রাত কাটাতে হয়। তারপর দৈববশে যদি সেই গাছের ওপর ব্যাঙ্গমার বাসা থাকে তবেই তার সাথে যোগাযোগ হবে। তার থেকে আমার জাহাজই ভাল।

সেই স্বপ্ন আমার কাছে ধরা দিয়েছে আজ। আর একটু পরেই জাহাজ ছাড়বে। ঐ যে ভোঁ বাজলো। পারের দিকে তাকিয়ে আছি। জাহাজ আস্তে আস্তে এগিয়ে চলেছে। ধীরে ধীরে ঘাটের আলোগুলো বিন্দুতে রূপান্তরিত হলো। ঘড়িতে নটা বেজে আঠারো মিনিট। সমুদ্রের হাওয়ায় শীতের আমেজ। কেবিনের দিকে পা বাড়াই।

ঘরে ঢুকে দেখি কার একটা ব্যাগ রাখা রয়েছে। ভাবি বুঝি অন্য কারো ঘরে ঢুকে পড়লাম। “ম্যাডাম, আমি কি আজ রাত এই ঘরে থাকতে পারি? আপনার যদি আপত্তি না হয় তো।” তাকিয়ে দেখি এক ভদ্রলোক আমার পিছনে দাঁড়িয়ে আছেন। সঙ্গে দুজন দেহরক্ষী। তাদের মধ্যে একজন সবিনয়ে বলতে লাগলো তাদের সাহেবকে হঠাৎ যেতে হচ্ছে। তাই বাধ্য হয়েই তিনি ইত্যাদি ইত্যাদি।

আমি আর কি করি। অগত্যা ‘তাহলে থাকুন’ বলে জিনিসপত্র সরিয়ে রাখি। ভদ্রলোক অতীব ভদ্রলোক। নিজেই পরিচয় করলেন। জানা গেল তিনি ভারতীয় নৌসেনার পাইলট। বাধ্যতামূলক স্বাস্থ্য পরীক্ষার পর তিনি কর্মস্থানে ফিরছেন।

ভোঁ—উঠে   পড়লাম। মায়াবন্দরের যাত্রী নামানোর সময় হয়ে গেছে। সমুদ্রের উপরে সূর্যোদয় হলো। জাহাজ আবার ঘাট ছাড়ল। আরেক ঘাটের উদ্দেশ্যে। আমি আবার ঘরে ফিরলাম। পাইলট সাহেব ততক্ষণে উঠে পড়েছেন। ‘গুড মর্নিং’ বললেন। তারপর আমাকে জাহাজ ঘুরিয়ে দেখাবেন বললেন। আমার তখন আনন্দ দেখে কে! পিছন পিছন চললাম। প্রথম নিয়ে গেলেন ডেকে। প্রতিটা যন্ত্র, মাস্তুল—তার ওপরের আলো। দড়ি, লাইফ-জ্যাকেট, লাইফ-বোট কোথায় থাকে। কিভাবে ব্যবহার করতে আপতকালীন সময়ে, সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বলতে লাগলেন। তারপর নিয়ে গেলেন জাহাজের প্রাণকেন্দ্রে। যেখান থেকে জাহাজ চালনা করা হয়। কম্পাস, প্রাচীনকাল থেকে নাবিকরা নৌচালনার সময় যে পদ্ধতি ব্যবহার করতেন, এখনও সেই মূল নিয়ম মেনেই জাহাজ চালনা করতে হয়। যন্ত্রপাতি অত্যাধুনিক, কম্পাস অত্যাধুনিক, কিন্তু বিদ্যুত বিভ্রাট হলে পুরোনো কম্পাসই ভরসা। কাপ্তেন সাহেব এসে আলাপ করলেন। উনি সব ঘুরিয়ে দেখানোর পর চা খাওয়ালেন। সেই সব করতেই সময় পার। দূর থেকে আমার ঘাট দেখা গেল। সবুজের, গাঢ় সবুজের আস্তরণের মাঝে একটুখানি ফাঁকা। ওই খানেই তো আমি নামব।

‘দিদি, এদিকে’—বিশুদ্ধ বাংলায় ডাক শুনে পিছন ফিরে দেখি ‘দীপঙ্কর’, আমাকে নিতে এসেছে।

পৌঁছলাম গিয়ে আমার চারদিনের আস্তানায়। এবার কেন এসেছি বলি। দূর, বহুদূর পৃথিবীর আরেক প্রান্ত থেকে কিছু অতিথি এই সময় আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের কিছু নির্জন সমুদ্রতটে আসে। কেন আসে? মা হবে বলে। হাঁ, ঠিক ধরেছেন। কিছু বিরল প্রজাতির সামুদ্রিক কচ্ছপ প্রতি বছর হাজার হাজার মাইল পার হয়ে এই ভারতবর্ষের মাটিতে ডিম পাড়তে আসে। মূলত পাঁচটি প্রজাতি। গ্রিন টারটেল, হক্সবিল, লেদারব্যাক, অলিভ-রিডলে এবং লগারহেড। তারা আসে, ডিম পাড়ে এবং ফিরে যায়। তারা জানে না তাদের বাচ্ছারা সবাই ফিরতে পারবে কিনা। কিভাবে পথ চিনে তারা তাদের মা-বাবার কাছে ফিরে যাবে। অদ্ভুত এক প্রাকৃতিক নিয়মের ক্রীড়নক তারা। প্রকৃতি কার জন্য কি নির্ধারন করেছে কেউ জানে না। আমি এসেছি সেই কচ্ছপ-মায়েদের সাথে দেখা করতে।

সমস্ত সমুদ্রতটে এখন জরুরী অবস্থা চলছে। পর্যটকরা রাত্রে বিশেষ কিছু সমুদ্রতটে  যেতে পারবেন না। কারণ, ভয় পেলে সেই বিশেষ সময়টুকুর ব্যবহার না করতে পারলে সেই আসন্ন প্রসবা কচ্ছপ-মা অসহায় হয়ে পড়বে। বিশেষ সময় বলছি তার কারণ আছে। অনেকগুলো শর্তের ওপর এই প্রসব করা নির্ভর করছে। দিনের বেলায় এই ঘটনা ঘটেই না। ঘটলেও তা প্রায় বিরল ঘটনা বলে গণ্য হয়। রাত্রিবেলা সমুদ্রে ভরা জোয়ারের সময় এই মা কচ্ছপরা জল ছেড়ে বলিয়াড়িতে উঠে আসে। তারপর নিজে পছন্দ মত জায়গায় বালি খুঁড়ে তার ভিতরে ডিম পাড়ে। এক সাথে প্রায় একশো দেড়শো ডিম পাড়ে।তারপর আবার বালি চাপা দিয়ে দেয়। তারপর ধীরে ধীরে আবার সমুদ্রে ফিরে যায়। যাবার সময় আর পিছন ফিরেও দেখে না। প্রকৃতির কি অদ্ভুত নিয়ম। অনাগত সন্তান তার, অজানা পরিস্থিতিতে, নিষ্ঠুর সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে তার মায়ের সাথে দেখা করবে বলে আবার সমুদ্রগামী হবে। এই সমস্ত ঘটনা ঘটতে মাত্র একঘন্টা থেকে দেড় ঘণ্টা সময় লাগে। ভরা জোয়ারেই মাকে আবার সমুদ্র ফিরে যেতে হবে।

এর পরের ঘটনার সাক্ষী হতে আমার এইবারের আন্দামান যাত্রা। সময় আর কাটে না। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হলো। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত। বিকেলে একবার ঘুরে এসেছি সমুদ্রের ধার থেকে। সমুদ্রও শান্ত। শুধু হাওয়ায় হাওয়ায় ফিসফাস। তারা আসছে, তারা আসছে। শুনে ছিলাম এই প্রজাতির কচ্ছপরা যেখানে জন্মগ্রহণ করে তার নিজেদের প্রসবের সময় সেখানেই ফিরে আসে। এটাই পরম্পরা। আবহমানকাল এই নিয়মের অনুসারী তারা। প্রসবের পর কাঁদতে কাঁদতে মায়েরা ফিরে যায়। ভাবতে ভাবতেই মন ভারী হয়ে ওঠে। গলার কাছে কি একটা দলা যেন আটকে যায়। আপনিই চোখ আমার জলে ভরে ওঠে।

মূলত, অস্ট্রেলিয়া থেকে এই কচ্ছপরা আসে। শিশু জন্মানোর পর বাচ্ছাদের খোলের উপর বনদপ্তরের কর্মীরা অস্ট্রেলিয়ার ছাপ লাগিয়ে দেয়। যে কচ্ছপরা আসে তাদের পিঠের খোলের উপর অস্ট্রেলিয়ার ছাপই এ পর্যন্ত পাওয়া গেছে।

রাত সাড়ে নটা নাগাদ আমি তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়লাম। ঈশ্বরকে স্মরণ করলাম। এমন এক মায়ের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি যে মা নিশ্চিন্তে তার সন্তানের দায়িত্ব প্রকৃতি মায়ের হাতে ছেড়ে দিতে পারে।

সমুদ্রের ধারে হাওয়া বইছে। আকাশ তারায় ভরা। জোয়ার এসে গেছে। জলের কুলু কুলু ঢেউ এখন ছলাৎছল বলছে। বনকর্মীরা সবাই সমুদ্রতটে ছড়িয়ে পড়েছে। মোবাইলের টর্চ জ্বেলে এদিক ওদিক তাকাচ্ছি। সময় আর কাটে না। আসবে তো? তার সাথে দেখা হবে তো আমার? পৌনে এগারটার সময় সবাইকে পিছনে সরে যেতে বলা হলো। এসেছে, সে এসেছে। দুটো মোবাইলের টর্চের আলোর বিন্দু তার পাশ দিয়ে চলেছে। ধীরে ধীরে সে এগিয়ে আসছে। অত পথ পাড়ি দিয়ে সে এসেছে শুধু তার সন্তানের জন্ম দিতে। আসন্ন প্রসবার প্রসব যন্ত্রনাও শুরু হয়েছে হয়তো। এক সময় সে থামে। আমি দম বন্ধ করে বসে আছি। এক জাগতিক সত্যের অপেক্ষায়। অবশেষে এল সেই মুহূর্ত। সে প্রথম ডিম দুটো প্রসব করল। হাঁ, এক সাথে দুটো করে ডিম। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে আমার। আমি প্রকৃতির এই চরম রহস্যের সাক্ষী হয়ে থাকলাম। বন দপ্তরের কর্মীরা পিছন দিক থেকে বালি সরিয়ে দিচ্ছেন। আমি ধীরে ধীরে মায়ের মুখের ঊপর হালকা আলো ফেললাম। মায়ের মুখ গর্বে ভরে উঠেছে। প্রথম মাতৃত্বের স্বাদ আস্বাদনের আনন্দে সে মুখ আলোকিত। তার দু-চোখের কোণে ঐ কি চকচক করছে? ধীরে তার পিঠের ওপর হাতটা রাখলাম। মাথাটা উপর দিকে তুলে দুবার সে ঢোঁক গিলল। গলা থেকে তার কি এক শব্দ হলো। হয়তো ঈশ্বরের কাছে সন্তানসকলের মঙ্গল কামনা করলো। হয়তো সদ্যজাতককে ছেড়ে যাওয়ার অসহ্য ব্যথা জানালো অথবা ঈশ্বরীয় নিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করল। জানিনা, তার চোখের জল আমার মাতৃসত্বাকেও ছুঁয়ে গেল। খোলা আকাশের নীচে সেই মায়ের সাথে আমিও কাঁদতে লাগলাম। তারপর আমার অবচেতনায় যেন শুনতে পেলাম, ‘আমি মা হয়েছি’।

তার ডিম পাড়া শেষ হয়ে গেছে। সে ফিরে যাচ্ছে। না, একবারও পিছন ফিরল না সে। ধীরে ধীরে প্রসবের ক্লান্তিকে সাথী করে, মা হবার গর্বে, আনন্দে তার ভাবীকালের সন্তানকে প্রকৃতি মায়ের হাতে সঁপে দিয়ে সে এগিয়ে চলেছে সাগরের দিকে। যে পথ দিয়ে তার সন্তানেরা তার যাত্রা সম্পূর্ণ করবে।

শনিবার, ৮ আগস্ট, ২০২০

ব্রতকথা !

 

আজ দিনটা খুব গরম ছিল। বিকেল বেলায়  ছাদে ওঠা এখন  প্রায় অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। গরমের জন্য আজ একটু দেরীতেই ছাদে উঠলাম । গিয়ে দেখি দিনমনি আজকের যবনিকাপাতের সব অনুষ্ঠানই সম্পূর্ণ করে ফেলেছেন প্রায়। পাখিও আর ডাকছে না। সূর্যাস্তের আর বিশেষ বাকি নেই। পৃথিবী শান্ত হয়ে এসেছে। সাত অশ্বের রথ মর্ত্যলোকের সীমা পার করে মেঘ রাজ্যে ঢুকে পড়েছে । ঘোড়ার ক্ষুরের আঘাতে মেঘগুলো ছোট ছোট টুকরো হয়ে যাচ্ছে । সেই রথের পাশ কাটিয়ে সন্ধ্যা নামছে ধীরে। আমি সেই দিকেই তাকিয়ে আছি। সামনে দিয়ে একা এক পাখি উড়ে গেল। সেই রথের উপর থেকে তিনি হাত নাড়ছেন। আমিও হাত জোড় করে তাঁকে প্রনাম জানাই। আজকের মত বিদায়। সেই টুকরো হয়ে যাওয়া মেঘগুলো আবারও হাত ধরাধরি করে এক হয়ে গেছে। এই দৃশ্যপটের ওপর তারা যবনিকা টেনে দিলো। এক মহাজাগতিক দিনের অবসান ঘটলো। 

এই রেশ টুকু যেন আর কাটতে চাইছে না। মন বলছে যেন এখানেই শেষ নয়, আরো কিছু আছে, আরো কিছু.........। এক ব্যথা বহুকাল, সে যে কতকাল, সে আর এখন মেপে বলতে পারি না, বয়ে নিয়ে চলেছি। সে ব্যথা একান্ত আমার। তাকে রাখি এমন আধার এই পৃথিবীতে নেই। অত্যন্ত মূল্যবান সে ব্যথাটুকু বর্তমানে আমার সম্পদে পরিণত হয়েছে। তাকে অতি যত্নে অন্তরের গভীরে, সেই যেখানে একটি দীপ অনির্বান শিখায় জ্বলছে, সেই আলোটির পাশেই রেখেছি। সেই শিখাটির আলো ছাড়া যে এই ব্যথার অস্তিত্ব অনুভবেই আসবে না

তারপর সেই কত রাতের বেলায় চারপাশের আঁধার চিরে বিদ্যুৎ চমকায়। গুরু গুরু সারা আকাশ জুড়ে বাজতে থাকে। সেই বিপুল উৎসবের সাক্ষী হয়ে প্রকৃতি আনন্দে আত্মহারা। গাছেরা আনন্দে লুটোপুটি খাচ্ছে। গাছে গাছে পাখির ডাক, সময়কে অকালে জাগিয়ে, প্রকৃতিকে আনন্দে মাতিয়ে অশুভকে সন্ত্রস্ত করে তার এই উপস্থিতি আমার সত্তাকে প্রান প্রাচুর্যের ধারায় ভরিয়ে তোলে। আমার সত্তা জেগে ওঠে। চারপাশের সকল ভাঙ্গনের শব্দে, অনুভবে যে বিশ্বাসের জোর অবিশ্বাসের পাঁকে চাপা পড়ে গিয়েছিল, সেই পাঁক সরে গিয়ে আবার, আবারও একবার সকল শুভ ইঙ্গিত ঝলমলিয়ে উঠলো। সেই প্রলয় ছন্দে অন্তরের দীপশিখাটিও কেঁপে উঠলোআজ এই মধ্যরাত্রের প্রলয় যাপনে রবি ঠাকুরের সেই কথাটি মনের ওপর দিয়ে বয়ে গেল, আর সকলেরে তুমি দাও, শুধু মোর কাছে তুমি চাও। এই মরুজীবনের পথে কত বার কত রূপে এসেছ এই ব্যথাটুকু হরণ করতে। তোমার সবটুকু উজাড় করে দিয়েছো, বিনিময়ে চেয়েছো এই ব্যথাটুকু। না, কোনো প্রলোভনেই এই বিনিময় পূর্ণতা পায় নি। আজ তুমি মেনে নিতে বাধ্য হয়েছো যে এ ব্যথা নিতান্তই আমার। তুমি ব্যর্থ হয়েছো। এই ব্যথাব্রত সাধনার আমিই সাধক। আর তাই, বারবার ফিরে ফিরে আসো আমার সাধনার তপোমন্দিরে। অতি যত্নে সুকোমল হাতে সব দুঃখ মুছিয়ে দাও। কিন্তু দুঃখের চিহ্ন মুছে দেওয়া, সে বোধহয় তোমারও সাধ্যের বাইরে। এক্ষেত্রে তোমারও সীমা নির্ধারিত করা আছে। জীবনের দুঃখকাল সময়ের সাথে অতীত হয়, কিন্তু দুঃখকালের স্মৃতি? সে শুধু ব্যথাই বয়ে আনে, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। তোমার নিজের হাতে যে দুঃখ দান করেছিলে আমায়, এতদিন পরেও কি সেকথা ভুলতে পেরেছো? আজ তোমার ব্যথাও সীমাহীন। এ ব্যথা তোমারও যাবার নয়। তাই তো আজ মন্দিরে আমার সাথে তোমারও আসন পেতেছি। একসাথে আজ দুজনেই এই ব্যথাব্রত উদযাপন করবো

এসো..................

কবিতা ৮ ।

 সপ্তসিন্ধু পার করে লখিন্দর ফেরে ঘরে।সাথে করে  বিবিধ রতন। শঙ্খ বাজে, উলু দেয় এয়োতি, পুরজন। বাপ তার, চন্দ্র সওদাগর। লখার সাফল্যে মুখে তার  গো...