"ম্যাডাম, আমরা
তাহলে আজ উঠি, যদি আরও কিছু মনে পড়ে তাহলে ফোন করবেন। এত ভেঙে পড়বেন না।"
রমা মাথা নাড়ে। পুলিশ অফিসার চলে গেলে দরজাটা বন্ধ করে আবার চেয়ারে বসে পড়ে। কি যে
দুশ্চিন্তা, কিন্তু ভেবে কোনো
কুল কিনারা পাওয়া যাচ্ছে না। তবে একটা কথা জলের মতো পরিষ্কার করে জানা গেছে; তার জীবনের
এই বিপর্যয়ের মূলে তার মা, হ্যাঁ, নিজের
মা। গ্রেপ্তারের
কথা পুলিশ বারবার বললেও সে সায় দিতে পারেনি, তার মূল্যবোধ তাকে পিছনে টেনে রেখেছে। ভাবছে আর ভাবছে, কি করবে সে এখন? এ
লজ্জার কথা কাকে বলবে, কে বিশ্বাস করবে? আত্মীয় স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী সবার মধ্যেই
একটা ফিসফাস, তাকানোর মধ্যেও একটা অস্বাভাবিক ভাব। অনেকক্ষণ পর চোখ মুছে জানলার
সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। গেটটা দেখা যাচ্ছে। রোজ সকালে বাবু স্কুলে যাওয়ার সময় ওখান
থেকেই বলতো, "মা, আসি",
বারান্দা থেকে সে হাত নাড়ত, বলতো, "সাবধানে
যেয়ো"। নিয়মমাফিক এই ঘটনারই পুনরাবৃত্তি
হতো রোজ। তবে, ওইদিন কি হয়েছিল? বাবু স্কুলে বেরিয়ে যাওয়ার পর রমা ছোট ছেলেকে ক্রেশে দিয়ে রোজকার মতোই
অফিসে গিয়েছিল। ফেরার পথে রোজকার মতোই ছেলেকে নিয়ে বাড়ি ফিরেছিল। বাড়ি ফিরে হাত পা ধুয়ে
চা বসায়। মায়ের হাতে চায়ের কাপটা দিয়ে বাবুর কথা জিজ্ঞাসা করে। মায়ের কাছে জানতে
পারে যে বাড়ির পাশের মাঠের মেলায় গেছে। কথায় কথায় আরও কিছু সময় কেটে যায়। আমি আসছি, রমা
বলে। মা
জিজ্ঞাসা করে, কোথায় যাচ্ছ? সে বলে, দেখি বাবুকে একবার। মা বলে ওঠে, তোমায়
একটা কথা বলার ছিল, বাবু বাড়ি থেকে চলে গেছে। কি, কি বললে? রমা চিৎকার করে ওঠে। তুমি তো এতক্ষন বললে না রমাকে থামিয়ে দিয়ে তিনি বলতে থাকেন, তোমাদের জন্য একটা
চিঠি লিখে রেখে গেছে। ভেবেছিলাম তোমাদের খাওয়া হয়ে গেলে বলবো। কি নির্বিকার ভাবে বলে যাচ্ছেন
তিনি, রমার
মাথায় কিছুই ঢুকছে না। সে আর সহ্য করতে পারে না, চিৎকার
করে বলে, “তুমি মিথ্যা কথা বলছো।" সেই চিৎকারে বাবা ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন। সব শুনে তার মায়ের দিকে তাকিয়ে
বলেন, “সেই সর্বনাশটা করলে!" বলতে
বলতে তিনি হু হু করে কেঁদে ফেলেন। আশি বছর বয়স তাঁর, এই বৃদ্ধ বয়সে এই শোক তিনি কি ভাবে সহ্য করবেন? কিন্তু
রমার অতো কথা ভাবার সময় কোথায় এখন, সে মাকে চেপে ধরে, “সত্যি কথা বলো,বাবু কোথায়?” না, কোনো
কথাই সে বলাতে পারে না। এর মধ্যে তার স্বামী ফিরে আসে। আর নিজেকে সে ধরে রাখতে পারে না, সব কথা বলতে গিয়ে সে কান্নায় ভেঙে পড়ে। সব শুনে তিনি রমাকে সাথে নিয়ে
থানায় যান। সব ঘটনা লিখিতভাবে জমা করে তারা বাড়ি ফিরে আসে। তারপর পরিচিত সব মানুষ জনের বাড়িতে ফোন করে। কোথাও থেকেই কোনো খবর তারা পায়
না। একা বসে বসে ভাবতে থাকে কোথায় আছে ছেলেটা, কি খাচ্ছে, ভাবতে ভাবতেই হু হু করে কেঁদে ওঠে সে। উফ, কি
কুক্ষণে বাবার কথায় রাজি হয়েছিল। নিজের ছোটবেলাটা আবার মনের আয়নায় ফুটে উঠতে থাকে। ছোট থেকেই সে কোনোদিন মায়ের আদর
পায় নি। ষাটের দশকের চাকরি করা আধুনিক মহিলা, বামপন্থী আদর্শে বিশ্বাসী, কিন্তু
প্রথম সন্তান মেয়ে? না, তিনি মন থেকে মানতে পারেন নি। বাবার দুচোখের মনি ছিল সে। দাদু ঠাকুমার আদরের দুলালী। এই
আদরের বহিঃপ্রকাশ তাঁর চোখে বাড়াবাড়ি মনে হতো। তার স্বাভাবিক জীবনের
বেড়ে ওঠার পথে পদে পদে অন্তরায় সৃষ্টি করেছেন, অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছেন। এরপর তার একটি বোন জন্মায়। তারপর তার মায়ের ঔদাসীন্য আরও
বেড়ে যায়। দুটি বোন একসাথে বড় হয়ে উঠছিল। তখন এইসব ঘটনা সমাজে গুরুত্বই
পেতো না। মায়েরা সবসময় সন্তানের ভালো চান, তাঁরা কোনো অন্যায় করতে পারেন না, যা
করেন সব সন্তানের ভালোর জন্য, এই সব চিন্তা ভাবনাই সমাজে মান্যতা পেতো। রমা পারিবারিক মূল্যবোধকে
জীবনের সার মেনে মুখ বুজে সব সহ্য করে এসেছে। আর সেজন্যই বাবা যখন তাঁর অবসর জীবন বড়ো মেয়ের
কাছে কাটাবেন বলে মনস্থির করেন, তখন রমা যে তার সাথে মায়ের সাথে সম্পর্কের কথা ভাবে নি তা নয়, কিন্তু স্নেহময় বাবাকে সব সময়ের জন্য কাছে পাওয়ার, সেবা করার সুযোগটুকু পেয়ে সে বাকিটা মানিয়ে নেবে বলেই
মনস্থির করে।,
প্রথম কয়েক মাস
আনন্দে কেটে যায়। দুই নাতিকে সঙ্গে পেয়ে বাবাও খুব আনন্দে আছেন। মা মায়ের মতো থাকেন। একদিন রাতে খেতে বসে মা সেই
পুরোনো দিনের কথায় ফিরে যান। তাঁর চাকুরী জীবনের কথায়, অপূর্ণ থাকা ইচ্ছার আলোচনায়। চাকরি করার সাথে সাথে তিনি বামপন্থী সরকারি
ইউনিয়নের নেত্রীও ছিলেন। দীর্ঘ দিন রাজনৈতিক ক্ষমতার কাছা কাছি থাকার জন্য সাধারণ আশাগুলোতেও
রাজনৈতিক ছোঁয়া লেগেছিল তাঁর। তিনি চেয়ে ছিলেন যে রমা সেই বামপন্থী দলের সর্বক্ষণের
কর্মী হিসেবে সেই দলে যোগদান করুক। কিন্তু
কোন কারণে সেটা হয়ে ওঠেনি । কথাচ্ছলে বল্লেও তাঁর উষ্মাটুকু তিনি
পারেন না লুকোতে। সেই কবেকার একটা সাধারণ ঘটনাকে তিনি তাঁর ব্যক্তিগত ব্যর্থতা হিসেবে এত বছর
ধরে চিহ্নিত করে রেখেছেন, রমা
ভাবে, কিন্তু আশ্চর্য হয় না, কারণ
সে তার মাকে চেনে। সেই সূত্রপাত। তারপর থেকে মাঝে মধ্যেই তিনি নিজের উষ্মা প্রকাশ করেন। বাবার সাথে ছোট খাটো ব্যাপারে
অশান্তি করেন। রমা বোঝায়। এই ভাবে দিন কাটতে থাকে। একদিন অফিসে বাবুর ফোন আসে, কান্না-ভেজা গলায় সে বলতে থাকে যে দিদিমা তার সামনে ছোট ভাইকে
মেরেছে।
অফিস থেকে ওরা ফিরতেই তিনি বলতে থাকেন ছোটছেলের
দুস্টুমির কথা। বাবু বলে দিদিমার খারাপ ব্যবহারের কথা। রমাদের
অনুপস্থিতিতে ছোট ভাইকে উত্যক্ত করার কথা। রাতে মায়ের কাছে শুয়ে বাবু জানায় সারাদিন
বাড়িতে নানা অচেনা মানুষের আসার কথা। মা কে জিজ্ঞাসা করলে বলেন অফিসের লোক, দেখা
করতে এসেছিল। রমার স্বামীর বদলির চাকরি, এমতাবস্থায়
তারা ঠিক করে যে দুই ছেলেকে আবাসিক স্কুলে ভর্তি করবে। এত
অশান্তি, বাবা একদিন বললেন
বৃদ্ধাশ্রমে চলে যাবেন। রমা কেঁদেই অস্থির হলো। এই বয়সে কিভাবে পরিবার থেকে দূরে
থাকবে? এর মধ্যেই দুই ছেলেকে তারা দার্জিলিংয়ের বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি করে। কিছুদিন
বাড়িতে শ্মশানের শান্তি বিরাজ করে। কিন্তু কিছুতেই সে মায়ের লাগাতার
অন্যায়ের প্রতিবাদ বাবার সামনে মুখ ফুটে করে উঠতে পারেনি। আত্মীয়
স্বজনের কথা ভেবে। তিন চার মাস যে না যেতেই বড়ো ছেলে খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে। জন্ডিস
ধরা পড়ে তার। বাধ্য হয়ে ওকে বাড়ি ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করতে হয়। বাড়ির কাছের এক
স্কুলে ওকে ভর্তি করে । মোবাইলটা বাজছে। ফোনটা ধরে সে। ওপার
থেকে এক আত্মীয়ের গলা ভেসে আসে। ওরা
আজ আসছে। রমা যেন মনে একটু জোর পায়।
কিন্তু এ কি শুনছে সে? তারা বলতে এসেছে যে রমার মাকে যেন পুলিশ জ্বালাতন না করে; রমা
প্রতিবাদ করে, এটা জ্বালাতন নয়, ওনার
উপস্থিতিতে এই ঘটনা ঘটেছে। পুলিশকে
সহযোগিতা করা উচিত এখন। বাবার
দিকে তাকায় রমা, দুচোখ দিয়ে জল পড়ছে তার। আবার
একবার বাবার ভরসার হাতটা মাথার ওপর অনুভব করে সে। চোয়াল শক্ত করে সে বলে চলে....তা
নাহলে মা প্রথম দিন থেকে মিথ্যে বলছেন কেন? মাথাটা ক্রমশ পরিস্কার হয়ে আসে তার,
স্পষ্ট ভাষায় সে মাকে বলে, “সত্যি
কথা তোমায় বলতেই হবে, নাহলে আমি C.I.Dর কাছে যাবো।”
“একটা কথা পরিষ্কার, আপনার মা সব জানেন", রমা
চমকায় না, "শুধু বয়সের কারণে ওনাকে থানায় আনা যাচ্ছে না, থানায় আনা
গেলেই উনি ব্রেক করতেন", "তাহলে
তাই করুন" রমা বলে। আমরাও তারই প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, কিন্তু আজ এক
রাজনৈতিক নেতার থেকে ফোন এসেছে। বুঝতেই তো পারছেন, আমরা সরকারি চাকরি করি। থানায় বসে অসহায় রমা তার থেকেও বেশি অসহায় প্রশাসনিক
আধিকারিকের দিকে তাকিয়ে থাকে। খানিক চুপ করে থেকে ওসি জিজ্ঞাসা করেন, “আচ্ছা, উনি
কি আপনার নিজের মা, না মানে বলছিলাম যে নিজের মা হলে এই কাজটা করা ওনার
পক্ষে করা সম্ভব হতো না।” কানের
ভিতর দিয়ে কথাগুলো ছেঁড়া ছেঁড়া ভাবে প্রাণে গিয়ে লাগে।তার মানে স্থানীয় থানা আর কিছু করতে পারবে না। নমস্কার
করে তারা থানা থেকে বেরিয়ে আসে। বাড়ি ফিরে আসার পথে সে উপলব্ধি করে যে মনের
ভিতর মায়ের সংজ্ঞাটা বদলে গেছে। আচ্ছা, কুমাতা
কি সত্যিই হয়? যদিও এখন সমাজ অনেক বদলে গেছে। বর্তমান সমাজে কুমাতার উদাহরণ বিরল নয়। কুমাতাও সমাজে এখন বিরল নয়। রাতে স্বামী স্ত্রী তে বসে ভাবে, এই ষড়যন্ত্রের হাত থেকে মুক্তির উপায় কি?
ঠিক সকাল দশ টায় C.I.D অফিসে
পৌঁছায় তারা। ছেলের হারিয়ে যাওয়ার বিবরণ লিপিবদ্ধ করে। আশায় বুক বাঁধে। এবার নিশ্চয়ই
একটা ব্যবস্থা হবে। বাড়ি ফেরার পথে পিয়নের সাথে দেখা হয়। সে একটা রেজিষ্ট্রি চিঠি দিতে এসেছিল, বাড়ি বন্ধ থাকায় ফিরে যাচ্ছিল। রমার নামেই চিঠি। মনের মধ্যে
তোলপাড় হয়, কিসের
চিঠি? মুক্তি পন নয়তো? তাড়াতাড়ি
চিঠি
খুলে দেখে আদালতের সমন। এ কী
নোংরা খেলায় মেতে উঠেছেন উনি? রমার
বিরুদ্ধে রমার বাবাকে দিয়ে কোর্টে মামলা করিয়েছেন, মিথ্যা অত্যাচারের নালিশ তার বিষয়বস্তু। ঘেন্নায় সারা শরীর কেঁপে ওঠে তার, এত নীচে নেমেছেন উনি যে নিজের মা হিসাবে ভাবতেও ঘৃণা
বোধ হচ্ছে। কি কুক্ষণে সে ওনাদের কাছে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, বিশ্বাস
করেছিল। চিঠিটা হাতে নিয়ে বাবার ঘরে যায়, তার পায়ের শব্দে বাবা ওর দিকে তাকান। রমা সেই কাগজগুলো বাবার দিকে
এগিয়ে দেয়। বাবা পড়তে থাকেন, সে খাটের উপর বসে পড়ে।
..... কিন্তু এই মামলা তো আমি করিনি, বাবা
বলেন। তাহলে, তাহলে
কি.......উফ, কি
সাংঘাতিক ষড়যন্ত্র। বাবার বয়ানে বাবার সই জাল করে এই মামলা করা হয়েছে। এক অশীতিপর, অসহায় বাবা আর তার মেয়ে, দুজনে
সেই নিস্তব্ধ ঘরে বসে আছে। বাবা ধীরে ধীরে তার মাথায় হাত রাখেন,
বলেন "আমায় ক্ষমা করে দিও তোমরা, আমারই
ভুল হয়েছিল। আমি তো তোমার মাকে চিনতাম, পুত্র সন্তান না জন্মাবার ক্ষোভ তার ছিল। ছেলেবেলা থেকেই তার সেই ক্ষোভের
শিকার তুমি ছিলে। আমি সর্বদাই তোমার ব্যথা অনুভব করতাম। অনেক বুঝিয়েছি তাকেও। তিনি আমাকেও কোনোদিন ক্ষমা করেন
নি। আমি এবং তুমি ওর কাছে সমান অপরাধী ছিলাম। সারা জীবন এই অকৃত অপরাধের ভার আমি
বয়ে চলেছি। আমি ভেবেছিলাম শেষ জীবনে দুই নাতিকে নিয়ে তিনি খুশি থাকবেন। কিন্তু তার
মনের বিকার যে এই পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে তা আমি ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি । পর ওর এই
দুটো ঘটনা আমার চোখ খুলে দিয়েছে, আজ আমার কাছে সব জলের মতো
পরিষ্কার হয়ে গেছে। আমার আর কিছু বলার নেই। তোমরা পারলে আমায় ক্ষমা করে দিও", বলতে
বলতে তিনি শিশুর মতো হাউহাউ করে কাঁদতে থাকেন। রমা চুপ করে বসে থাকে, সান্ত্বনার
ভাষা হারিয়েছে সে, কি নারকীয় মানসিক অত্যাচার তিনি সহ্য করেছেন। আজ সহ্যের শেষ সীমায় এসে ভেঙে
পড়েছেন একেবারে। সে ভাবতে থাকে কি কুটিলতার সাথে তার মা একটার পর একটা অপরাধ করে
চলেছেন পাকা অপরাধীর মতো। একটা অপরাধকে ঢাকতে গিয়ে আরেকটা অপরাধ করছেন, কি সাঙ্ঘাতিক প্রতিশোধ স্পৃহায়। সব বোধ হারিয়েছেন তিনি।
উদ্দেশ্য শুধুমাত্র রমার ক্ষতি করা। তাঁর কাছে রমা সন্তান নয়, এক না চাওয়া সামাজিক বাধ্যতা। কি চরম মানসিক বিকৃতি। তিনি নিজে যা পান নি রমা কেও তা
পেতে দেবেন না। কি ভীষণ ষড়যন্ত্র করেছেন দিনের পর দিন। কেউ অবিশ্বাস করতে পারবেনা।
এখন নিজেকে বাঁচাবার জন্য মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে
দিচ্ছেন। “আমায়
একটু জল দাও।" সে
বাবাকে জল এনে দেয়। বাবা নিজেকে সামলে নিয়েছেন অনেকটা। কিন্তু বাবুকে তার তো খুঁজে বার করতেই
হবে, তার
সাথে এই মামলায় লড়তে হবে। কোথায়, কার
কাছে যাবে সে, ভাবতে গিয়ে হঠাৎ তার মনে পড়ে ব্যারিস্টার জেঠুর কথা। ছোটবেলায় বাবার সাথে যেত। হাওড়ায়
বাড়ি। নামকরা মানুষ, বাড়িটা
খুঁজে পেতে অসুবিধা হয় না তার। নাম পরিচয় বলতেই চিনতে পারেন তিনি। সব কথা খুলে বলে
রমা। শুনতে শুনতে তিনি স্বগতক্তির মতো
বলতে থাকেন, “এত বছরেও স্বভাবের কোনো পরিবর্তন হলো না, বুঝলে, কর্মক্ষেত্রেও
ওনার ওই স্বভাবের জন্য সবাই এড়িয়েই চলতো, মানুষের ক্ষতি করতে ওনার হাত কোনো দিন কাঁপে নি। সরকারি চাকরি আর রাজনৈতিক
ক্ষমতার জোরে যা খুশি করেছেন তিনি। কেউ কোনোদিন ওনার বিরুদ্ধে মুখ খুলতে সাহস পায় নি। তুমি বোধ হয় ওনার আজীবনের শেষ
শিকার। সবাই এড়িয়ে গেলেও তুমি ওনার কাছ থেকে পালাতে পারবে না, কারণ তুমি ওনার সন্তান। আত্মীয়দের চোখে তিনি তোমায়
অপরাধী বানিয়েছেন, এবার
আইনের চোখেও তোমায় অপরাধী বানাবেন। ওনার বয়সটাকে উনি ঢাল বানিয়েছেন। দীর্ঘদিন আমি ওনাকে খুব
কাছ থেকে দেখেছি। মানসিক অত্যাচার করে উনি যত আনন্দ
পান, আর
কিছুতে তিনি অত আনন্দ পান না।"
রমা ব্যাকুল হয়ে প্রশ্ন করে, “তাহলে
কি হবে?" “আমি লড়ব এই মামলা.....রমা
ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলে। “চোখ
মোছ, কেঁদে কোনো লাভ নেই। এ লড়াই লড়তেই হবে। তোমার জানা
দরকার, তোমার
বাবার ভালোমানুষির সুযোগ নিয়ে অফিসে অনেক হেনস্থা ওনাকেও করেছেন। কিন্তু কোনোদিন ভাবিনি ওনার
বিরুদ্ধে মামলা লড়তে হবে। এত নীচে নামা ওনার পক্ষেই সম্ভব। আর এটাই বোধ হয় নিয়তি। সারা জীবন ধরে সবাইকে জব্দ করতে
করতে আজ নিজের জালে নিজেই পড়েছেন। আদালতের ফাঁদে তোমায় ফেলতে গিয়ে নিজের কি
সর্বনাশ ডেকে এনেছেন উনি জানেন না। ওনার অন্যায়ের বৃত্ত সম্পূর্ণ হয়েছে। তোমার এই কষ্ট আমি নিতে পারবো
না, কিন্তু
এই মামলা আমি লড়ব।" নতুন ভরসায় বুক বেঁধে রমা বাড়ি ফিরে আসে।
তার পরের ঘটনা সংক্ষিপ্ত। আদালতে মামলা ওঠে। বাদী পক্ষ বাবা, বিবাদী পক্ষ মেয়ে, এই
মামলা বাবা করেন নি, এক
তৃতীয়পক্ষের জালিয়াতিতে এই বিচিত্র মামলার উৎপত্তি। এই তৃতীয় পক্ষ হলো বাবার অগ্নিসাক্ষী
করে বিয়ে করা স্ত্রী আর মেয়েটির জন্মদাত্রী মা। বাবা লজ্জায় স্ত্রীর বিরুদ্ধে
কোথাও অভিযোগ জানাতে পারেন নি, স্ত্রীর
কৃতকর্মের দায় নিজের মাথায় নিয়ে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আছেন। বাবাকে নাস্তানাবুদ হতে দেখে
সে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। কিন্তু এ যে কুরুক্ষেত্র, কোনো উপায় নেই। সওয়াল জবাবের শুনানিতে মাননীয়
বিচারকের কিছু বুঝতে বাকি থাকে না। মাত্র দুই বছরের মধ্যেই এই মামলার নিষ্পত্তি হয়।
আদালত অত্যন্ত রূঢ় ভাষায় বাদীপক্ষের নিন্দা করেন। মাননীয় আদালত এই মামলাকে
গার্হস্থ্য হিংসার এক অন্যতম দৃষ্টান্ত হিসাবে চিহ্নিত করেন। সেই ভীষণ দিনে বাবা
তাঁর বিবাহিত স্ত্রীর সকল কৃতকর্মের ফল মাথায় নিয়ে আদালত থেকে ফিরেছিলেন। তাঁর
ন্যুব্জ দেহ আরও ঝুঁকে পড়েছিল। রমা পাথর হয়ে গিয়েছিল। সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে
দেখেছিল সেই মহিলার আচরণ, যেন
কিছুই হয় নি।
আজ বাবার ছবির সামনে দাঁড়িয়ে কত কথা মনে পড়ে যায়। এক বিকৃত বুদ্ধি, অপরাধী মননের মানুষের সাথে দীর্ঘ দাম্পত্য জীবন কি
বিভীষিকাময় ছিল তাঁর, কি ভীষণ যন্ত্রনা তিনি পেয়েছেন সারা জীবন ধরে। কিন্তু কি অসীম ধৈর্য্যের সাথে সেই অগ্নিকে সাক্ষী রেখে
করা "যদিদং হৃদয়ং তব" মন্ত্রের
সন্মান আমৃত্যু রক্ষা করে গেছেন। আজ তার বাবার চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকী।