“হার না মেনে লড়ছেন রিয়া, তাই চরিত্র
হনন ?” চোখ আটকে যায় সম্পাদকীয়তে। এই সময় সংবাদপত্রে ১৭ই সেপ্টেম্বর ২০২০-এর প্রতিবেদন।
হঠাৎই মনটা আনন্দে ভরে ওঠে। আজকের মেয়েরা সমাজের অসুখটা চিহ্নিত করে ফেলেছে। সমাজে
নির্লজ্জ রূপটা সারা পৃথিবীর সামনে প্রকাশ করে দিয়েছে। অপরাধ প্রমাণ হলে শাস্তি পেতে
হবেই, সবাই জানে। কিন্তু, চরিত্র নিয়ে একি নোংরামি! ভারতীয় সমাজ কোনদিনই স্বাধীনচেতা,
আত্মবিশ্বাসী ও আত্মনির্ভর মেয়েদের পছন্দ করে না। সমাজের নারী পুরুষ নির্বিশেষে সবাই
এই রোগে আক্রান্ত। ভারতীয় পুরাণ ও মহাকাব্যে এর প্রমাণ আছে অনেক। চরিত্র কাকে বলে?
স্মৃতিপথ বেয়ে
মন পিছন দিকে হাঁটে। একটা
মুখ, আবছা একটা মুখ, অসহায় একটা মুখ স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে। ছোট একটি
ছেলের হাত ধরে
বাবার বাড়ির দরজায় কড়া নাড়ে। “কি ব্যাপার,
তুমি?” মা
দাঁড়িয়ে দরজায়। “জামাই
কই?” “আমি আর ওখানে যাব না, মা”, বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়ে
মেয়েটি। “আচ্ছা,
আচ্ছা, বোসো তো এখন, বাকি কথা পরে
হবে”।
হাত মুখ ধুয়ে ঘরে বসে সে। কিছু
ভাল লাগছে না। “এস দাদুভাই, কখন এলে?” বাবা
বাজার থেকে ফিরেছেন। ব্যাগদুটো
হাতে নিয়েই মা গজগজ করে, আবার চলে এসেছে তোমার মেয়ে। কত করে
বোঝালাম, শ্বশুরবাড়িতে ওরকম একটু আধটু হয়, সেগুলো মানিয়ে নিতে হয়। “আঃ, একটু থামো তো, কই রে খুকি—কান্নাটা আর আটকাতে পারলো না সে। “বাবা” বলে
হাউ হাউ করে কেঁদে ওঠে। “শান্ত
হ দেখি, শুনি কি হয়েছে?”
নতুন কিছু শোনানোর নেই, গতানুগতিক একই ঘটনা। আজ তার
সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে।
সব শুনে বাবা বলেন, থাক আমার কাছে কটা দিন। সব ঠিক
হয়ে যাবে। কিন্তু
মেয়েটি জানে আর কিছুই ঠিক হবার নয়। স্বামী দুশ্চরিত্র,
মদ্যপ। মাইনের
টাকা তার
নিজে শখ আহ্লাদেই শেষ কয়ে যায়। শ্বশুর
শ্বাশুড়ী কথায় কথায় শোনান। শারীরিক অত্যাচার এখন নৈমিত্তিক
ব্যাপার। গায়ে
হাত
তোলা শুরু হয়েছিল তার গয়না নেওয়ার প্রতিবাদ করায়। সেদিন শখ মেটানোর
টাকা তার কাছে ছিল না, তাই গয়না চাই। সেই
নিয়ে কথা কাটাকাটি। তারপর জোরজার, তারপর শারীরিক বলপ্রয়োগ। আর পারেনি
সে আটকাতে। সারা
রাত একা
ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে কেঁদেছিল। সকালে শাশুড়িকে
সব খুলে বলে সে। তিনি
সব শুনে হেসে বলেন, “তা বাপু, প্রথমেই যদি দিয়ে দিতে,
তাহলে তো আর মার খেতে হতো না”। যত
বার বাপেরবাড়ি এসে বাবা মাকে বলে
সে, তারা বলেন
“একটু সহ্য করো, সব ঠিক হয়ে যাবে”। এমনই কাটে
তার দিন। কিন্তু
কাল তাকে পরিষ্কার বলে দেওয়া হয়েছে, তাদের ছেলে সংসারে টাকা
দেয় না। তাই তার
ভরণ পোষণ তারা করতে
পারবেন না। বাবা
সব শুনে চুপ করে বসে থাকেন। “তাহলে আর কি, সারাজীবন থাকো এখানে
পড়ে। তা,
তাদের ছেলেটাকে সঙ্গে করে নিয়ে এলে কেন? তাদের ছেলে তাদের কাছে দিয়ে এলেই পারতে”, মা বলতে থাকেন। পায়ের নীচের
মাটিটা কেঁপে উঠেছিল কি তখন? কদিনে মনটাকে শক্ত করে নেয় সে।
চাকরি
একটা তাকে পেতেই হবে। খবরের
কাগজ দেখে পাগলের মতো চাকরির খোঁজ করতে থাকে। বেসরকারি চাকরি
একটা পায় সে। সকাল
দশটা থেকে বিকেল সাড়ে পাঁচটা। সকালে বেরোয়। সন্ধ্যাবেলা বাড়ি
ফেরে। ছেলের চার
বছর বয়স হলো। তার
স্কুলে ভর্তির ফর্ম তুলে আনে। রাতে খেতে
বসে মা জিজ্ঞাসা করে, “তাহলে
কি ঠিক করলে? এখানেই থেকে যাবে? আমাদের মানসম্মানের কথাটা মাথায় এল না”। সে মায়ের দিকে তাকায়। মা খুবই
বিরক্ত। বাবাকে বলেন,
“এই মেয়ে আমাদের পরিবারের নাম
ডোবাল। বিয়ের পর
মেয়েরা সংসার করে না একথা কোনদিন শুনিনি বাপু। বাবা কথার
উত্তর দেন না। সে
ছেলেকে নিয়ে খাওয়া ছেড়ে উঠে যায়। “যত্ত সব আমার কপালে, পাড়ার সব
লোক জিজ্ঞাসা করে”,
পিছনের থেকে মা বলে ওঠে।
সন্ধ্যেবেলা স্টেশন থেকে একা বাড়ি
ফেরা। একদিন একটি
ছেলে কটুক্তি করে। ও
তাড়াতাড়ি পা চালায়।
বাড়ি ফিরে এসে বলে। বাবা বলেন,
“কাল থেকে আমি আনতে যাব”। “কি জানি কি কেলেঙ্কারি ঘটবে এবার”, মা বলে ওঠেন। বাবা রেগে
বলেন, “আবার
শুরু করলে তুমি”।ছোট ছেলেটা মায়ের মুখের দিকে
তাকিয়ে থাকে।
বাড়ি
ফিরে দেখে দরজার বাইরে অনেক চটিজুতো রাখা। পরদা সরিয়ে
দেখে তার স্বামী, তার বোন আর বোনের বর। “এতদিন
কি রাগ করে থাকতে হয়? কোথায় গিয়েছিলে? তুমি সত্যিই চাকরি করছো না কি? মাসীমা বলছিলেন”।
কোন উত্তর না দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সে। মা এলেন বড় এক ট্রে হাতে, মিষ্টির থালা। “দেখ না,
এত করে বোঝাচ্ছি, কিছুতেই শুনছে না। স্বামীর সাথে রাগারাগি কার সংসারে হয় না বল তো, তাই বলে
শ্বশুরঘর করবে না?” ঘেন্নায় কথা বন্ধ হয়ে গেছে তার। এ কি তার নিজে মা? ননদ বলে, না
না, চাকরি-বাকরি করতে হবে না। আমাদের বাড়িতে
ওসবের চল নেই। নাও তো, জিনিসপত্র গুছোও, নাতির জন্য মায়ের খুব মন খারাপ”। “না, আমি
যাব না। চাকরিও ছাড়ব না”। “তা যাবে কেন, ওনার স্বাধীনতা চাই”, মা বলে ওঠে, “তা, তোমরা
এক কাজ কর, তোমরা তোমাদের বংশের নাতিটিকে
নিয়ে যাও। শেষ বয়সে দাদু ঠাকুমা নাতিকে দেখতে পাবে না, তা কি হয়! ও থাক ওর চাকরী নিয়ে”।
“না”, ও ছুটে ওর ঘরে ছেলেকে নিয়ে দরজা বন্ধ
করে দেয়। শত ধাক্কাধাক্কিতেও খোলে না। সারা রাত ছেলেকে বুকে জড়িয়ে শুয়ে থাকে।
দিন কেটেই যাচ্ছিল। একদিন শমন আসে তার নামে। খুলে দেখে, বিচ্ছেদের
মামলা হয়েছে। বাবাকে বলে। মা বলতে থাকে, “আমাদের বংশে এরকম আগে কখনো ঘটে নি। এখনও মিটিয়ে
নাও সব গণ্ডগোল, ফিরে যাও শ্বশুরবাড়ি”। সে মাথা নিচু করে কাগজটা পড়তে থাকে। তাতে লেখা,
দুশ্চরিত্রা স্ত্রীকে নিয়ে সংসার করা সম্ভব নয়, তাই এই মামলা করে বিচ্ছেদ চাওয়া হয়েছে।
এ কী দেখছে সে! এত অত্যাচার সহ্য করা কোনো মেয়ের পক্ষে সম্ভব? সেই আবছা মুখখানা যেন
একটু একটু করে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। সেই দিশাহারা জীবনকে পিছনে ফেলে সে এক দিশা খোঁজে।
চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে তার। চোখ থেকে অগ্নিস্রোতের লাভা গড়িয়ে নামে দু-গাল বেয়ে। ছেলের
হাতটা শক্ত করে ধরে চটিতে পা গলায়। সে এই লড়াই লড়বে। মনকে শক্ত করে সে। মনের মেরুদণ্ড
হলো চরিত্র। কবির কথা মনে পড়ে তার; ভীষণ দুর্দিনে মানুষের বুদ্ধির নয়, চরিত্রের পরীক্ষা
হয়। আজ সে শুভদিন। সেই পরীক্ষা দেবে সে। কতগুলো নিচুমনের মানুষের বিকৃত চিন্তার খোরাক
হয়ে থাকবে না। এই অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে জীবনের খাতার পাতায় তার জীবনদেবতার সাক্ষর
নিয়ে বেঁচে থাকবে সে। নাম যে তার আগ্নেয়া।