রবিবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২০

পুনর্জন্ম

“হার না মেনে লড়ছেন রিয়া, তাই চরিত্র হনন ?” চোখ আটকে যায় সম্পাদকীয়তে। এই সময় সংবাদপত্রে ১৭ই সেপ্টেম্বর ২০২০-এর প্রতিবেদন। হঠাৎই মনটা আনন্দে ভরে ওঠে। আজকের মেয়েরা সমাজের অসুখটা চিহ্নিত করে ফেলেছে। সমাজে নির্লজ্জ রূপটা সারা পৃথিবীর সামনে প্রকাশ করে দিয়েছে। অপরাধ প্রমাণ হলে শাস্তি পেতে হবেই, সবাই জানে। কিন্তু, চরিত্র নিয়ে একি নোংরামি! ভারতীয় সমাজ কোনদিনই স্বাধীনচেতা, আত্মবিশ্বাসী ও আত্মনির্ভর মেয়েদের পছন্দ করে না। সমাজের নারী পুরুষ নির্বিশেষে সবাই এই রোগে আক্রান্ত। ভারতীয় পুরাণ ও মহাকাব্যে এর প্রমাণ আছে অনেক। চরিত্র কাকে বলে?

স্মৃতিপথ বেয়ে মন পিছন দিকে হাঁটে। একটা মুখ, আবছা একটা মুখ, অসহায় একটা মুখ স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে। ছোট একটি ছেলের হা ধরে বাবার বাড়ির দরজায় কড়া নাড়ে। “কি ব্যাপার, তুমি? মা দাঁড়িয়ে দরজায়। “জামাই কই? আমি আর ওখানে যাব না, মা, বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়ে মেয়েটি। “আচ্ছা, আচ্ছা, বোসো তো এখন, বাকি কথা পরে হবে”।

হাত মুখ ধুয়ে ঘরে বসে সে কিছু ভাল লাগছে না। “এস দাদুভাই, কখন এলে? বাবা বাজার থেকে ফিরেছেনব্যাগদুটো হাতে নিয়েই মা গজগজ করে, আবার চলে এসেছে তোমার মেয়ে। কত করে বোঝালাম, শ্বশুরবাড়িতে ওরকম একটু আধটু হয়, সেগুলো মানিয়ে নিতে হয়। “আঃ, একটু থামো তো, কই রে খুকিকান্নাটা আর আটকাতে পারলো না সে। “বাবা বলে হাউ হাউ করে কেঁদে ওঠে। “শান্ত হ দেখি, শুনি কি হয়েছে? নতুন কিছু শোনানোর নেই, গতানুগতিক একই ঘটনা। আজ তার সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে সব শুনে বাবা বলেন, থাক আমার কাছে কটা দিন। সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু মেয়েটি জানে আর কিছুই ঠিক হবার নয়। স্বামী দুশ্চরিত্র, মদ্যপমাইনের টাকা তার নিজে শখ আহ্লাদেই শেষ কয়ে যায়। শ্বশুর শ্বাশুড়ী কথায় কথায় শোনানশারীরিক অত্যাচার এখন নৈমিত্তিক ব্যাপার। গায়ে হা তোলা শুরু হয়েছিল তার গয়না নেওয়ার প্রতিবাদ করায়। সেদিন শখ মেটানোর টাকা তার কাছে ছিল না, তাই গয়না চাই। সেই নিয়ে কথা কাটাকাটি। তারপর জোরজার, তারপর শারীরিক বলপ্রয়োগ। আর পারেনি সে আটকাতে। সারা রাত একা ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে কেঁদেছিল। সকালে শাশুড়িকে সব খুলে বলে সে। তিনি সব শুনে হেসে বলেন, তা বাপু, প্রথমেই যদি দিয়ে দিতে, তাহলে তো আর মার খেতে হতো না”। যত বার বাপেরবাড়ি এসে বাবা মাকে বলে সে, তারা বলেন একটু সহ্য করো, সব ঠিক হয়ে যাবে”। এমনই কাটে তার দিন। কিন্তু কাল তাকে পরিষ্কার বলে দেওয়া হয়েছে, তাদের ছেলে সংসারে টাকা দেয় না। তাই তার ভরণ পোষণ তারা করতে পারবেন না। বাবা সব শুনে চুপ করে বসে থাকেন। “তাহলে আর কি, সারাজীবন থাকো এখানে পড়েতা, তাদের ছেলেটাকে সঙ্গে করে নিয়ে এলে কেন? তাদের ছেলে তাদের কাছে দিয়ে এলেই পারতে”, মা বলতে থাকেন পায়ের নীচের মাটিটা কেঁপে উঠেছিল কি তখন? কদিনে মনটাকে শক্ত করে নেয় সে

চাকরি একটা তাকে পেতেই হবেখবরের কাগজ দেখে পাগলের মতো চাকরির খোঁজ করতে থাকে। বেসরকারি চাকরি একটা পায় সে। সকাল দশটা থেকে বিকেল সাড়ে পাঁচটা। সকালে বেরোয়। সন্ধ্যাবেলা বাড়ি ফেরে। ছেলের চার বছর বয়স হলো। তার স্কুলে ভর্তির ফর্ম তুলে আনে। রাতে খেতে বসে মা জিজ্ঞাসা করে, তাহলে কি ঠিক করলে? এখানেই থেকে যাবে? আমাদের মানসম্মানের কথাটা মাথায় এল না”। সে মায়ের দিকে তাকায়। মা খুবই বিরক্ত। বাবাকে বলেন, এই মেয়ে আমাদের পরিবারের নাম ডোবাল। বিয়ের পর মেয়েরা সংসার করে না একথা কোনদিন শুনিনি বাপু। বাবা কথার উত্তর দেন না। সে ছেলেকে নিয়ে খাওয়া ছেড়ে উঠে যায়। “যত্ত সব আমার কপালে, পাড়ার সব লোক জিজ্ঞাসা করে, পিছনের থেকে মা বলে ওঠে

সন্ধ্যেবেলা স্টেশন থেকে একা বাড়ি ফেরা। একদিন একটি ছেলে কটুক্তি করে। ও তাড়াতাড়ি পা চালায়। বাড়ি ফিরে এসে বলে। বাবা বলেন, কাল থেকে আমি আনতে যাব”। “কি জানি কি কেলেঙ্কারি ঘটবে এবার, মা বলে ওঠেন। বাবা রেগে বলেন, আবার শুরু করলে তুমিছোট ছেলেটা মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে

বাড়ি ফিরে দেখে দরজার বাইরে অনেক চটিজুতো রাখা। পরদা সরিয়ে দেখে তার স্বামী, তার বোন আর বোনের বর। “এতদিন কি রাগ করে থাকতে হয়? কোথায় গিয়েছিলে? তুমি সত্যিই চাকরি করছো না কি? মাসীমা বলছিলেন”। কোন উত্তর না দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সে। মা এলেন বড় এক ট্রে হাতে, মিষ্টির থালা। “দেখ না, এত করে বোঝাচ্ছি, কিছুতেই শুনছে না। স্বামীর সাথে রাগারাগি কার সংসারে হয় না বল তো, তাই বলে শ্বশুরঘর করবে না?” ঘেন্নায় কথা বন্ধ হয়ে গেছে তার। এ কি তার নিজে মা? ননদ বলে, না না, চাকরি-বাকরি করতে হবে না। আমাদের বাড়িতে ওসবের চল নেই। নাও তো, জিনিসপত্র গুছোও, নাতির জন্য মায়ের খুব মন খারাপ”। “না, আমি যাব না। চাকরিও ছাড়ব না”। “তা যাবে কেন, ওনার স্বাধীনতা চাই”, মা বলে ওঠে, “তা, তোমরা এক কাজ কর, তোমরা তোমাদের বংশের নাতিটিকে নিয়ে যাও। শেষ বয়সে দাদু ঠাকুমা নাতিকে দেখতে পাবে না, তা কি হয়! ও থাক ওর চাকরী নিয়ে”। “না”, ও ছুটে ওর ঘরে ছেলেকে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। শত ধাক্কাধাক্কিতেও খোলে না। সারা রাত ছেলেকে বুকে জড়িয়ে শুয়ে থাকে।

দিন কেটেই যাচ্ছিল। একদিন শমন আসে তার নামে। খুলে দেখে, বিচ্ছেদের মামলা হয়েছে। বাবাকে বলে। মা বলতে থাকে, “আমাদের বংশে এরকম আগে কখনো ঘটে নি। এখনও মিটিয়ে নাও সব গণ্ডগোল, ফিরে যাও শ্বশুরবাড়ি”। সে মাথা নিচু করে কাগজটা পড়তে থাকে। তাতে লেখা, দুশ্চরিত্রা স্ত্রীকে নিয়ে সংসার করা সম্ভব নয়, তাই এই মামলা করে বিচ্ছেদ চাওয়া হয়েছে। এ কী দেখছে সে! এত অত্যাচার সহ্য করা কোনো মেয়ের পক্ষে সম্ভব? সেই আবছা মুখখানা যেন একটু একটু করে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। সেই দিশাহারা জীবনকে পিছনে ফেলে সে এক দিশা খোঁজে। চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে তার। চোখ থেকে অগ্নিস্রোতের লাভা গড়িয়ে নামে দু-গাল বেয়ে। ছেলের হাতটা শক্ত করে ধরে চটিতে পা গলায়। সে এই লড়াই লড়বে। মনকে শক্ত করে সে। মনের মেরুদণ্ড হলো চরিত্র। কবির কথা মনে পড়ে তার; ভীষণ দুর্দিনে মানুষের বুদ্ধির নয়, চরিত্রের পরীক্ষা হয়। আজ সে শুভদিন। সেই পরীক্ষা দেবে সে। কতগুলো নিচুমনের মানুষের বিকৃত চিন্তার খোরাক হয়ে থাকবে না। এই অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে জীবনের খাতার পাতায় তার জীবনদেবতার সাক্ষর নিয়ে বেঁচে থাকবে সে। নাম যে তার আগ্নেয়া।  


মঙ্গলবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০২০

করোনার সাক্ষাতে


 

চার দিকে শুধু হাত ধোও, পা ধোও, কাউকে ছুঁয়ে ফেলার বিড়ম্বনা থেকে মুক্তি পাও। কি ভাবে ধুতে হবে তাও টেলিভিশনে শেখানো হচ্ছে। এই মাত্র শুনলাম, একুশ দিন বাধ্যতামূলক ঘর বন্ধ হয়ে থাকতে হবে। অচেনা অসুখ, স্পর্শ থেকে, নিশ্বাস থেকে সংক্রমিত হওয়ার ভয়ে বাড়ি থেকে বেরোনো নিষেধ। ছাদের বাগানে বসে আছি সকাল থেকে, নিশ্চিন্তে, সংক্রমণের ভয় নেই

ওটা কি? আমার দিকেই তো তাকিয়ে আছে, ক্যামেরাটা হাতের কাছেই ছিল। যেই ওর দিকে তাকে করেছি, ওমা ঠিক বুঝতে পেরেছে ওর ছবি তুলব, অমনি বেরিয়ে এসে আমার কোলের উপর বসে আর কি! কাছাকাছি হতে ভালো করে দেখতে পেলাম। ছোট বলের মতো, গায়ে কাঁটা কাঁটা আছে, খুব চেনা লাগছে, অথচ চিনতে পারছি না। মুখটা হাসিতে ভরা।... কি হলো ছবি তোল, ছবি তুলতে গিয়ে চিনতে পারলাম, আরে, এত করোনা। আমি ভ্যা করি আর কি। ও তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, না, না কেঁদো না, কেঁদো না, কাঁদলেই সর্দি হবে, আর সর্দি হলেই.......ভয়ের চোটে কাঁদতে ভুলে গেলাম। ক্যামেরা রেখে তাড়াতাড়ি সানিটাইজারের শিশিটা খুলি। হাতে ঢেলে ওকে দেখিয়ে দেখিয়ে ভালো করে ঘষতে লাগলাম। আমায় হাত ঘষতে দেখে ও একটু সরে দাঁড়ালো। ভয় দেখাচ্ছ আমায়, আমি তো তোমাদের ভালোই চাই। আমি বলি, তাই নাকি? তোমার ভয়ে পৃথিবীর কি অবস্থা হয়েছে দেখো। ও জিজ্ঞাসা করে, কি হয়েছে? লজ্জা করে না, না কি চোখের মাথা খেয়েছো, সারা পৃথিবীতে কত লোক মারা গেল আরও কত যে যাবে, জানি না

ও একটু কাছে এগিয়ে এলো, বললো, তোমরা মৃত্যুকে খুব ভয় পাও, তাই না? আমি বলি, হ্যাঁ, পাই তো, কে না পায় শুনি, তুমি পাও না? ফিক করে হাসে, বলে, না, পাই না। আমরা অমর। পৃথিবীতে কোনো শক্তি নেই যে আমাদের নাশ করে। আমায় একটু জল দেবে? বলে আমার বোতলের দিকে এগিয়ে যায়। আহা করো কি, করো কি, আমি চেঁচিয়ে উঠি, ও থতমত খায়, তাকিয়ে দেখি, খুব শুকনো দেখাচ্ছে ওকে। একটু বসি, খুব ক্লান্ত লাগছে। বসো, তবে একটু দূরে, আমি বলি। মুখটা তার খুশিতে ভরে উঠলো। ওই যে, শেষের আগের টবটায়, যেটায় পিটুনিয়ার শেষ ফুলটা ফুটেছে ঠিক সেটার ওপরে গিয়ে বসলো। শিশিরের ফোঁটাটা বুঝি তখনও শুকায় নি, সেটুকু পান করে সে একটু চুপ করে বসে রইলো

আমি সকালে ফুল তোলার পর কিছুটা সময় ছাদেই কাটাই। এ সময় এ কী আপদ! আরেকবার সানিটাইজার দিয়ে হাত ধুয়ে নিলাম। সামনেই করোনা বসে আছে। উফ, শান্তি নেই

কি যেন বলছিলে, সে কথার খেই ধরে আমার দিকে ফেরে.....বলছিলাম, কেন এই পৃথিবীকে এত ভয় দেখাচ্ছ, এখানে এমনিতেই এত সমস্যা, আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে সে বলে, এই তো, নিজেদের গুনের কথা বলে ফেললে, বলি, তোমরা যে ধর্মের নামে, জাতের নামে, দেশপ্রেমের নাম করে পৃথিবী জুড়ে মানুষ মারছ, তার বেলা? আমার নাম করে ঢাক বাজিয়ে বেড়াচ্ছ আমি নাকি তোমাদের মৃত্যুর জন্য দায়ী? নিজেরা যখন খুন করছো তখন তো ঢাক বাজিয়ে বলছো না? এ বলে কি? এত খবর এ পেল কোথা থেকে? আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে গলা উঁচু করে বলে, সব কথা বলবো নাকি? আমি বলি, থাক, থাক, সকালবেলায় এসব কথা ভালো লাগে না, কোথায় একটু ঠাকুরের গান শুনবো, তা নয়, "বেশ, বেশ, তাহলে ঠাকুরের কথাই বলি, এই যে তোমরা সব জন্মেছ মরনশীলতা নিয়ে। তোমাদের বানিয়েছে যে সেই ব্রহ্মা ঠাকুর, নশ্বর আর মরণশীল করে তোমাদের বানিয়ে ইস্তক কি যে আফসোস তার, ভাগ্যিস তোমরা মরণশীল, না হলে না জানি তার ভাগ্যে আর কি ছিল? আচ্ছা, তোমায় একটা কথা জিজ্ঞাসা করি, তোমরা মানুষেরা মরতে ভয় পাও কেন? কেন মানতে চাও না যে জন্মালে মরতেই হবে এই পৃথিবীতে  সকল প্রাণী, সবাই সময় ফুরোলেই পৃথিবী ছেড়ে যায়, আর এই  বেশিদিন বেঁচে থেকে পৃথিবীটার কি উপকারটা করছো শুনি? এই সুন্দর পৃথিবীটার কি দুরবস্থাটাই না করেছ। জল, হওয়া সব বিষিয়ে দিয়েছ। আর যে কথা বলছিলাম, তোমাদের উৎপাতে ব্রহ্মা ঠাকুরের সকল সৃষ্টির মধ্যে আর সমানুপাত থাকছে না" আমি বলি, সে আবার কি? বুঝতে পারছো না, কত জন্ম পার করে, কত কত জন্ম মৃত্যুর ভিতর দিয়ে একটা আত্মার উৎকর্ষ ঘটে, তবে সে মানব শরীরে স্থান পায়। আবার মানব জীবনের অন্তে নিজের নিজের কর্মফল অনুসারে তাকে বিভিন্ন প্রাণীরূপে জন্মগ্রহণ করতে হয়। এবার তোমরা কি করেছো দেখো। সব প্রাণী মরছে তোমরা ছাড়া, তোমাদের ঘরে খালি জন্মাচ্ছে। বাকি প্রাণীদের কথা একবার ভাবো, সবার প্রায় বংশ বিলোপ হওয়ার অবস্থা। সকল প্রাণীর আত্মা উন্নীত হতে হতে অবশেষে মানব শরীর পায়, কিন্তু মানবজাতি মরতে না চাইলে সৃষ্টিকর্তার কাজ ব্যাহত হয়।...এই দেখ, এই সব আষাঢ়ে গল্প তুমি কোথায় পেলে? সে বলতে থাকে, আষাঢ়ে নয়, এই কথা তিনি নিজের মুখে বলেছেন আর আমরা নিজের কানে শুনেছি। আমি বলি, বটে, বটে, তা এসব কথা তিনি কাকে বললেন? আমাদের শিবঠাকুরকে গো, আমরা সব তাঁর বাড়িতেই থাকি কিনা, সারা বছর ওনার কাজ করি। শুধু এই বসন্তকালে যখন পৃথিবী শীতের চাদর সরিয়ে অপরূপ রূপ ধারণ করে তখন আমাদেরও আর ঘরে মন টেকে না। এই এক মাস আমাদের ছুটি মঞ্জুর হয়। আমরা তখন এখানে ছুটি কাটাতে আসি”।“আমরা, আমরা যে করছো আমার মুখের কথা টেনে নিয়ে সে বলতে থাকে, আমরা মানে আমরা, আমাদের যে তিনি নিজের হাতে সৃষ্টি করেছেন, তাইতো আমরা অমর। আমি হেসে ফেলি, বলি, তা তোমরা যে বেড়াতে বেরোলে, তাতে তাঁর যে খুব অসুবিধা হবে, কাজকর্মগুলো করবে কে?" আছে, আছে, তাঁর কি কাজের লোকের অভাব? বন্যা, খরা, মড়ক, কালবৈশাখী সবাই আছে। তিনি তাঁর কাজের জন্য আমাদের সবাইকে নিজের হাতে সৃষ্টি করেছেন। সবাই বছরের কোনো না কোনো সময় ছুটি পায়, এবার বুঝেছো? বুঝলাম.......আবার একবার হাতটা পরিষ্কার করে নিই, কে জানে কোথা থেকে কি হয়? তা এখন তোমার মতলব কি শুনি? সে বলে, মতলব আবার কি একটু বেড়াতে এসেছি আর তোমরা আমায় কি বদনামটাই না দিলে, অতিথির সাথে বুঝি এমন ব্যবহার করতে হয়? বলতে বলতে ওর গলা ধরে এলো, খানিক চুপ করে থেকে আবার বলতে লাগলো, আমায় একজন বলেছিল, পৃথিবীতে কেউ ঈশ্বরকে মানে না  আমি প্রতিবাদ করি, বললেই হলো, আমাদের রোজ পূজা, উপবাস, আরতি, নকুলদানা..... তুমি বুঝি কোনো মন্দিরে যাও নি? "না" সে বলে, কিন্তু শুনেছি, মন্দিরে একটা পাথরকে ওরা দেবতা বলে। সেই দেবতার অনেক টাকা, সবাই পূজা করে, আশীর্বাদ হিসেবে তারা খালি টাকা চায়। সবাই দেবতার কাছে যেতে পারে না, শুধু যাদের অনেক টাকা তারাই যেতে পারে। মন্দিরের দেবতারা খালি বড়োলোকদের ভালোবাসে, শুধু তাদের কথা শোনে। দুঃখী মানুষের কথা দেবতারা শোনেও না, ভাবেও না। আচ্ছা, মন্দিরের পাথরের মূর্তিগুলো (যাদের তোমরা দেবতা বলো), তারা টাকা নিয়ে কি করে?" বড় শক্ত প্রশ্ন। উঃ, আমি ভয়ে মরছি তায় আবার এত প্রশ্ন

আমি কথার প্রসঙ্গ পাল্টাতে চাই, প্রশ্ন করি, কি কি দেখলে?  তার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। বললো, অনেক কিছু। জলের নীচে কতো মাছ। বড় একটা মাছ আমাকে ফোয়ারার জল ছিটিয়ে স্নান করিয়ে দিল। একটা মাছ আমায় খেতেও এসেছিল। তারপর একটা কচ্ছপের পিঠে চড়ে ডাঙায় উঠলাম। চারপাশে তাকিয়ে দেখি বড় বড় সব গাছ। নাম-না-জানা সব ফুল। আমায় বসতে দিলো, খেতে দিলো। বিশ্রাম নিলাম। তারপর সেই জঙ্গল  থেকে বেরোবার পথ ধরলাম। সেই পথ এক গ্রামে গিয়ে শেষ হলো। কি সুন্দর সেই গ্রাম, পিছনে তার এক বরফের পাহাড় প্রথম কদিন ঠিকই ছিল। তারপর একদিন ফিসফাস কানে এল। এক নাকি করোনা বলে কেউ এসেছে। সে যাকে ছুঁয়ে দিচ্ছে সেই নাকি মরে যাচ্ছে। তার গায়ে নাকি কাঁটা আছে। নদীতে স্নান করতে গিয়ে নিজের ছবি দেখে আমি চমকে উঠি। আমার গায়ে কাঁটা। এরা আমার কথা বলছে না তো? কদিন যেতেই বুঝতে পারলাম, আমাকেই ওরা করোনা বলে ডাকছে খুব মন খারাপ হয়ে গেল আমার। একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছি, এ রাস্তা, ও রাস্তায়, সেখানে দেখি আরেক কান্ডপথচারী দেখলেই লাঠি হাতে কিছু লোক তাদের তাড়া করছে, তাদের মারছে। আমার খুব কষ্ট হলো। আচ্ছা, মানুষ হয়ে মানুষকে মারতে তোমাদের কষ্ট হয় না? তারপর শুনলাম, সবাই ঘরে বসে আছে, কেউ বাইরে বেরোচ্ছে না, পাছে আমার ছোঁয়ায় অসুখ করে আমি এত দুঃখেও হাসতে লাগলাম। জাতিভেদ, দারিদ্র্য, এত বড় বড় অসুখ থাকতে আমাকে তোমাদের এত ভয়? আমার থেকে পালাতে পারো কিন্তু ওই অসুখগুলো থেকে পালাবে কোথায়? আবার শুনি, বসন্তের হাত থেকে বাঁচার জন্য তোমরা একটা দেবতা বানিয়েছ। আমি দেখছি আর ভাবছি যে এই দেবতাগুলোকে তোমরা কোথা থেকে  পেলে? এদের তো ঈশ্বর সৃষ্টি করেন নি জানো, সব শুনতে শুনতে আমার দেবতা দেখার ইচ্ছে হয়েছিল। মন্দিরের মধ্যে  ঢুকেছিলাম। দেখলাম, প্রায় তোমাদেরই মতো দেখতে, শুধু নড়া চড়া করতে পারে না। ওই মূর্তিগুলোকে তোমরা ভয় পাও। সর্বব্যাপী ঈশ্বর আর তোমাদের মাঝে ওই মূর্তিগুলো বিচিত্র ভয় আর মায়া দিয়ে এক দূরত্ব তৈরি করেছে। ওই দেবতাদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে তোমরা ঈশ্বরের হাত থেকে মুক্তি পাবে? ঈশ্বর ভাবছেন, এই অপূর্ব সৃষ্টিকে কি ভাবে রক্ষা করবেন, আর তোমাদের দেবতারা ভাবছেন, তোমাদের বোকা বানিয়ে কিভাবে ঈশ্বরের স্থানটা দখল করবেন

ওকি, তুমি আমার দিকে এগিয়ে আসছ কেন, ওখানেই তো বেশ বসে ছিলে, বলতে বলতে আমি তাড়াতাড়ি হাতে সানিটাইজারটা ঢালি, ও বলে চলে, এক দেবতা নামের জড় পদার্থকে ভরসা করে সৃষ্টিকে ধ্বংসের খেলায় মেতেছ তোমরা, তোমাদের সৃষ্ট দেবতারাও তোমাদের সাথেই বিনষ্ট হবে একদিন, নিশ্চিত রূপে .....এই একদম কাছে আসবে না, আমি আর বাঁচতে চাই না, আমাকে দিয়েই শুরু হোক" বলতে বলতে সে আমার হাতের উপর এসে বসলো। আমার হাতের ঘষায়, সানিটাইজারের এলকোহলে করোনার ছোট্ট সুন্দর শরীরটা থেঁতলে গলে গেল। আমার দুচোখ ঝাপসা হয়ে গেল। কত সহজ ভাবে ও শিখিয়ে দিয়ে গেল, কোনো মহত উদ্দেশ্যে প্রাণ রক্ষার থেকে প্রাণদানের প্রয়োজন অনেক বেশি

কবিতা ৮ ।

 সপ্তসিন্ধু পার করে লখিন্দর ফেরে ঘরে।সাথে করে  বিবিধ রতন। শঙ্খ বাজে, উলু দেয় এয়োতি, পুরজন। বাপ তার, চন্দ্র সওদাগর। লখার সাফল্যে মুখে তার  গো...